উপজেলার ১৫ ডকইয়ার্ডে নির্মাণ ও মেরামত হচ্ছে লঞ্চ, ট্রলার, কার্গো জাহাজসহ বিভিন্ন নৌযান, কর্মসংস্থান হয়েছে তিন সহস্রাধিক শ্রমিকের
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলা সদর। এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষের ঘুম ভাঙে খুটখাট শব্দের বিরামহীন আওয়াজে। উপজেলার ১৫টি ডকইয়ার্ড থেকে ভেসে আসা এ শব্দ কাকডাকা ভোরে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলে। উপজেলার সদর, সোহাগদল, সুটিয়াকাঠি, বলদিয়া এলাকায় অবস্থিত এসব ডকইয়ার্ডে ৩০ ফুট থেকে পৌনে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ট্রলার, লঞ্চ ও কার্গো-জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত করা হয়। স্বরূপকাঠি ও আশপাশের একাধিক উপজেলার তিন সহস্রাধিক শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ হয়েছে এখানে।
জালের মতো বিছানো নদী-খালসমৃদ্ধ স্বরূপকাঠিতে একসময় ছিল বাহারি নৌকার সমাহার। মাল্লাদের গাজি গাজি সুরে পালতোলা আর বদর বদর ধ্বনিতে দাঁড়ের ঝুপঝাপ শব্দে বিমোহিত হতো গোটা নদী তীরের মানুষ। কিন্তু সেই সুমধুর সুর এখন আর শোনা যায় না। এখন শুধু ইঞ্জিন আর ভেঁপুর কান-ফাটানো শব্দ। সন্ধ্যা নদী ও এর শাখা শিকলা, ইন্দুরহাট ও নান্দুহার খালের চার-পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত দুই ধারে দেখা যাবে অগণিত ট্রলার, কার্গো জাহাজ সারি সারি বাঁধা। কোনোটিতে যাত্রী ও মালামাল তোলা হচ্ছে, কোনোটি থেকে নামানো হচ্ছে আবার কোনোটি অলস সময় কাটাচ্ছে।
জানা গেছে, স্বরূপকাঠি উপজেলা একটি ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে কাঠের ব্যবসা ওই অঞ্চলকে গোটা দেশে পরিচিতি দিয়েছে। ওই অঞ্চলের কাঠসহ নানা পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহূত হতো নৌকা। কালের বিবর্তনে সত্তর দশকের শেষ ভাগে মান্ধাতা আমলের নৌকার পাশাপাশি ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রচলন শুরু হয়। কাঠের পরিবর্তে আসে ইস্পাতের নৌযান। পরে ওই সকল ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও মিনি কার্গো-জাহাজ তৈরি ও মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ড গড়ে ওঠে। এগুলো ছাড়াও এখানে তৈরি হচ্ছে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের জাহাজ।
উপজেলার সম্ভাবনাময় এই ডকইয়ার্ড শিল্পের দিন দিন প্রসার ঘটছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ উপজেলার আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা সুন্দরবনের কাঠ ব্যবসার সাথে জড়িত। ব্যবসার সেই ধারাবাহিকতায় এই এলাকার জয়নাল আবেদিন (মহাজন) সর্বপ্রথম ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই গোড়াপত্তন ঘটে স্বরূপকাঠির ডকইয়ার্ড শিল্পের। এর কিছুদিন পরে সোহাগদল গ্রামের মোসলেম আলী ও সুটিয়াকাঠির নওয়াব নূর হোসেন এবং স্বরূপকাঠির শিকলা খালের মোহনায় সামসুল হক হাওলাদার ও হেমায়েত উদ্দিন ডকইয়ার্ড নির্মাণ করেন। এরপর ইঞ্জিনচালিত ছোট লঞ্চ, ট্রলার, মিনি ও বড় মালবাহী জাহাজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্বরূপকাঠি উপজেলার সন্ধ্যা নদী তীরসহ স্বরূপকাঠি, কালিবাড়ি, বরছাকাঠি, বালিহারী, পঞ্চবেকী, তারাবুনিয়া, নাওয়ারা খালের তীরে গড়ে উঠে আরো ডকইয়ার্ড।
বর্তমানে এখানে ছোট-বড় ১৫টি ডকইয়ার্ড রয়েছে। এই শিল্পে নির্মাণ ঠিকাদার, ওয়েলডিং, সেটিং, কাটিং, ডক সারেং ও রং শ্রমিকের পেশায় কর্মরত থেকে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ওই সব ডকইয়ার্ডে ১ টন ধারণ ক্ষমতার ছোটমাপের ট্রলার থেকে শুরু করে ১১-১২ শ’ টন ধারণ ক্ষমতার কার্গো জাহাজ নির্মাণ করা হচ্ছে। স্বরূপকাঠি ডকইয়ার্ড, রোকসানা-আলম ডকইয়ার্ড, তারাবুনিয়া ডকইয়ার্ড, ছালেহিয়া ডকইয়ার্ডে বড় বড় জাহাজ নির্মাণ করা হচ্ছে। সমপ্রতি স্বরূপকাঠি ডকইয়ার্ডে নির্মাণ করা এমভি জাবলে নূর নামের একটি বড় জাহাজ নদীতে নামানো হয়েছে। ওই জাহাজটি তৈরি করতে ঢাকার চেয়ে ১০-১৫ লাখ টাকা খরচ কম হয়েছে। তাছাড়া বাড়ি বসে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করার কারণে গড়নও ভালো হয়েছে।
তারাবুনিয়া ডকইয়ার্ডের নির্মাণ ঠিকাদার মোমিন শেখ জানান, ১ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার একখানা জাহাজ তৈরি করতে ৭-৮ মাস সময় লাগে। সব খরচ বাদে এতে তার ১ থেকে দেড় লাখ টাকা আয় হয়। বরিশাল সদরের সেটিং শ্রমিক সাব্বির ইসলাম জানান, ডকইয়ার্ডে দৈনিক ৪০০ টাকা বেতনে কাজ করে ভালভাবেই দিন কাটছে তার। তবে এখানে দৈনিক ৩৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমিকদের।
নির্মাণ শ্রমিক মো. পারভেজ জানান, একসময় বেকার ছিলাম। ১০ বছর আগে প্রতিবেশি ফারুকের সহায়তায় স্বরূপকাঠি ডকইয়ার্ডে প্রথমে ১২০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করি। বর্তমানে ৫শ টাকা দৈনিক মজুরি পাই।
স্বরূপকাঠি ডকইয়ার্ডের নির্মাণ ঠিকাদার মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি ২৫ বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত থেকে স্বরূপকাঠির বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এখানে ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের সার্ভিস লঞ্চ, কোষ্টার, বাল্কগেটও নির্মাণ করা সম্ভব।
এদিকে ডকইয়ার্ডগুলোকে কেন্দ্র্র করে এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, স্টিল প্লেট এ্যাঙ্গেল, ওয়েল্ডিং রড, হার্ডওয়্যার ও রংয়ের কারখানা গড়ে উঠেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানেও অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ডকইয়ার্ড শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তারা জানান, জাহাজ নির্মাণের কাঁচামাল আনা হয় চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী, কুমিরা, সীতাকুন্ড ও ঢাকার পোস্তাগোলা থেকে। নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচামালের ৮৫-৯০ ভাগ ভেঙে ফেলা জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাকি ১০-১৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। একজন জাহাজ মালিক জানান, বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ কোষ্টার ও মালবাহী জাহাজ নির্মাণে প্লান অনুমোদন বন্ধ রাখার কারণে অনেক শিল্প উদ্যোক্তা জাহাজ নির্মাণ করতে পারছেন না। আসাদুজ্জামান ডকইয়ার্ডের মালিক আসাদ জানান, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে নির্মাণ কাজ ব্যাহত হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুতের অভাবে শ্রমিকদের বসে থাকতে হয়। মালিকদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
ডকইয়ার্ড মালিক সমিতির সম্পাদক মো. তৌফিকুল ইসলাম বলেন, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, বরগুনা, পটুয়াখালী, মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একশ্রেণির জাহাজ মালিক এখান থেকে নতুন জাহাজ নির্মাণ করে নিয়ে যান। অপর একশ্রেণির ট্রলার, মিনি কার্গো জাহাজের মালিকরা এ সকল ডকইয়ার্ডে মেরামত ও রংয়ের কাজ করান। তিনি আরও বলেন, উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে সরকারিভাবে ভূমি বন্দোবস্ত ও নিয়মিত বিদ্যুত্ সরবরাহ পেলে এ শিল্পের আরো ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
ডকইয়ার্ড মালিক সমিতির সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ জানান, ডকইয়ার্ড শিল্প মানুষের কর্মসংস্থানের একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সম্ভাবনাময় এ ডকইয়ার্ড শিল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
প্রসঙ্গত, প্রাচীনকাল থেকেই নৌকা ও জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশের খ্যাতি রয়েছে। চট্টগ্রামে নির্মিত হতো ঐতিহ্যবাহী জাহাজ ও কাঠের নৌকা। ইউরোপের পরিব্রাজক সিজার ফ্রেডরিকের ভাষ্য মতে, চট্টগ্রাম পঞ্চদশ শতকে এ অঞ্চলের কাঠের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মূল কেন্দ্র ছিল। সপ্তদশ শতকে তুরস্কের সুলতানের জন্য পুরো ফ্লিট তৈরি করেছিল চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। মুঘল আমলেও বাংলা জাহাজ ও নৌকা তৈরির কাজে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে দেশের প্রায় অধিকাংশ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানগুলো সারা দেশের অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ এবং মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণ ও মেরামত করে যাচ্ছে।- ইত্তেফাক