বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দেশমাতৃকার সেবার পাশাপাশি বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। শৃঙ্খলা ও আন্তরিকতা হচ্ছে পেশাগত উৎকর্ষ ও নিজেকে আদর্শ সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি-এ কথা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ভালো করেই জানেন। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অবদানের কথা স্মরণ করেই ২১ নভেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় সেনা-নৌ-বিমান-এই তিন বাহিনী ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ পালন করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অবদানকে স্মরণ করলে আমরা দেখতে পাই, সাত বীরশ্রেষ্ঠের সবাই সামরিক ব্যক্তি। বীর-উত্তমদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কোনো বেসামরিক ব্যক্তি নেই। মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তার অনেকেই অবসরের পরও দেশকে নানা ক্ষেত্রে সেবা দিচ্ছেন। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আরো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বর্তমান বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী একটি পরিচিত ও আস্থার প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্যোগময় পরিবেশে শান্তি স্থাপন করে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যেকোনো সংস্থার সদস্যদের সম্পৃক্ততা কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, বরং তার সঙ্গে রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত। শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যে অর্থ উপার্জন হয়, তা রেমিট্যান্স। আর রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সরঞ্জাম অন্য দেশে নিয়ে ব্যবহারের ভাড়া বাবদ বিপুল অর্থপ্রাপ্তি ঘটে। রাষ্ট্রের এই উপার্জন দীর্ঘদিন থেকে ধরে রেখেছে সশস্ত্র বাহিনী। গত বছর (২০১৪) জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় সৈন্য সরবরাহকারী রাষ্ট্র। এ জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হলে সেখানে মাঠপর্যায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয় নিবিড় হবে। তা ছাড়া জাতিসংঘ মিশন থেকে ফেরা বাংলাদেশি কর্মকর্তারাও মাঠপর্যায়ের চাহিদাগুলোর বিষয়ে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সব শান্তিরক্ষী সততা, শৃঙ্খলা ও সাহস নিয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেওয়া সৈন্যদের প্রশিক্ষণে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট ট্রেনিং’ (বিপসট) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে এক লাখ ১৮ হাজার ৯৮৫ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন। শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সদস্যসংখ্যা আট হাজার ৯৩৬, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের পতাকাতলে একত্র হন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মোট ৯৬ জন সদস্য শহীদ হয়েছেন; পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন ১৪ জন।

শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ বিশ্বের বিরোধপূর্ণ স্থানে জাতিসংঘের ডাকে শান্তি স্থাপন করা এ জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জরুরি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। জাতিসংঘকে শান্তি স্থাপনে সহায়তা দেওয়া এবং পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যানধারণা, চিন্তাচেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হচ্ছে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচিত্র রকম আবহাওয়ায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় ২০০ আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যানবাহন নিয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ ওসমান ও মধুমতী লেবানন এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সর্বদা টহলের কাজে মোতায়েন রয়েছে। মিশন এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলোতেও তাদের সতর্ক পাহারা দেখা যায়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী বিআর-১৩০ এয়ারক্রাফট, এমআই-১৭ ও বেল হেলিকপ্টারের মাধ্যমে কঙ্গো ও আইভরি কোস্টে জরুরি সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন, উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ তৎপরতায় দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ পুলিশের অনেক সদস্য মিশন এলাকার স্থানীয় প্রশাসনকে দাঙ্গা দমনে সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বের বিশৃঙ্খল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে শান্তি স্থাপনে সাফল্য অর্জন করাও বাংলাদেশ মিশনের শান্তি প্রকল্পের অন্যতম কাজ। শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশি নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে একটি মাইলফলক। শান্তি রক্ষা মিশনের দায়িত্বে থাকা হার্ভে ল্যাডসাউ এ দেশের নারী শান্তিরক্ষীদের অবদানের প্রশংসা করেছেন।

জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ উৎসাহব্যঞ্জক। শান্তি রক্ষা মিশনে সেনা মোতায়েনের সংখ্যার বিচারেও অনেক দিন ধরে শীর্ষস্থান দখল করে আছে আমাদের দেশ। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমুন্নতি বিধানের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর বিশ্বশান্তি স্থাপনের ভূমিকাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা দরকার।

লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও