একটা সময় বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে যে ডেনিম কাপড় প্রয়োজন হতো, তার পুরোটাই চীন অথবা পাকিস্তান থেকে আমদানি হতো। ভারত থেকেও আসত কিছু কিছু। তবে এ দেশে ডেনিম কাপড় তৈরির মিল স্থাপিত হওয়ার পর থেকে অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে। দৃশ্যপট অনেকখানিই বদলে গেছে গত কয়েক বছরে। বাংলাদেশ এখন তার চাহিদার প্রায় অর্ধেক কাপড় দেশেই উৎপাদন করছে, আগামী দিনে যা আরো বাড়বে।
শুধু কাপড় উৎপাদন নয়, বাংলাদেশ এখন ধৌত করা বা ওয়াশিংয়েও অনেক এগিয়ে গেছে। বহু ধরনের বৈচিত্র্যের কাপড় উৎপাদন ও ওয়াশ করা সম্ভব হচ্ছে বাংলাদেশেই। এমনকি টি-শার্ট তৈরির জন্য ডেনিম কাপড়ও এখন বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে। এ দেশের কাপড়ের মানও চীন ও পাকিস্তানের চেয়ে কম নয়। এ কারণে ইউরোপ-আমেরিকার বড় ক্রেতাদের নজর পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। ফলে ডেনিমের ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ডেনিম খাতের বড় সম্ভাবনার দরজা খুলতে শুরু করেছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) শুরু হওয়া ‘বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো’তে অংশ নেওয়া কম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, ডেনিম কাপড় উৎপাদনে বিনিয়োগও বাড়ছে। আগের কারখানাগুলোর প্রায় সবাই তাদের উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়েছে, নতুন অনেকে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। ওই প্রদর্শনীর আয়োজন করছে বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রদর্শনীতে ইউরোপের বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এসে বাংলাদেশের সক্ষমতা দেখছেন। তাঁরা উৎপাদকদের সঙ্গে এ দেশ থেকে কাপড় কেনার সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন। কম্পানিগুলো বলছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে যেসব ডেনিম কাপড়ের চাহিদা আছে, তা চীনের চেয়েও ভালো মান রক্ষা করে তৈরি করতে পারে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি সরবরাহে সময় কম লাগে বলে এখন বাংলাদেশের কাপড় দিয়েই পোশাক তৈরি করে রপ্তানি বাড়ছে। প্রদর্শনীর আয়োজকরা জানান, এ দেশে এখন ২৫টি ডেনিম কাপড় উৎপাদনকারী টেক্সটাইল মিল রয়েছে। এসব মিলে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। মিলগুলো মাসে প্রায় তিন কোটি গজ কাপড় উৎপাদন করছে। তবে এখনো তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি গজ কাপড় আমদানি করতে হচ্ছে। এ দেশে প্রায় ৪০০ পোশাক কারখানা বছরে প্রায় ১৮ কোটি পিস ডেনিম পোশাক রপ্তানি করে। ইউরোপের বাজারে জিন্স রপ্তানিতে বাংলাদেশ চীনের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। গতকাল ওই প্রদর্শনীতে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. ফারুক হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন ডিজাইন ছাড়া সব কিছুই বাংলাদেশে হয়। আমরা ডেনিম তৈরি শিখে গেছি, এখন বহু ধরনের ডেনিম কাপড় বাংলাদেশে তৈরি হয়। ওয়াশিংয়ে মান উন্নত হয়েছে এবং বৈচিত্র্য এসেছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি বাংলাদেশে আছে। আগামীতে ডেনিম খাত খুব দ্রুত এগোবে।’
বাংলাদেশের ডেমিন খাতে সর্বশেষ কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ডেনিমস লিমিডেট। গত অক্টোবর মাসে তারা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে। এর আগে তারা শুধু সুতা উৎপাদন করত। সিলেটের হবিগঞ্জে তাদের কারখানায় এখন থেকে উন্নত মানের ডেনিম কাপড়ও তৈরি হবে।
মেলায় অংশ নেওয়া স্কয়ারের ডেপুটি ম্যানেজার দাউদ বিন জাফর জানান, দামি পোশাক বিক্রির প্রতিষ্ঠান জার্মানির হুগো বসের প্রতিনিধিরা তাঁদের কারখানা ঘুরে দেখে গেছে। লিভাইস ব্র্যান্ডের ডেনিম এখন বাংলাদেশে কয়েকটি কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে। মেলায় স্কয়ারের সঙ্গে কথা বলেছে নেক্সট, ওভিএস ইতালি, কেজিএস সোর্সিং নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, ‘কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি করলে যে খরচ পড়বে, তার চেয়ে আমরা অনেক কম দরে ও কম সময়ে দিতে পারব। ফলে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে কিনতে চাচ্ছে।’
ডেনিম কাপড় ও পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মাহমুদ গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, চীনারা এখন আর বেসিক ডেনিম উৎপাদনে আগ্রহী নয়। তারা ফ্যাশনেবল ডেনিম তৈরি করছে। ফলে বাংলাদেশের বাজার বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মাহমুদ গ্রুপের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম জানান, একজন ক্রেতা একটি কারখানাকে পোশাক তৈরির জন্য সাধারণত তিন মাস সময় দেয়। এ ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে কাপড় আমদানি করতে গেলে অনেক সময় লাগে। বাংলাদেশ দেশীয় কারখানাগুলোকে অনেক দ্রুত দিতে পারে। এ কারণেই এ দেশের কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে।
নাসা ডেনিমের এক্সিকিউটিভ মো. মোরশেদুল ইসলাম জানান, লিভাইস, জারা, সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএম, কে মার্ট, ওয়ালমার্ট, জর্জসহ অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মেলায় তাঁদের স্টলে গেছে। তাদের অনেকেই এখন বাংলাদেশি কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করছে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. ফারুক হাসান জানান, আমস্টার ডেনিম, কেবিএল, ডেনিম ম্যাডহাউস, ডিআর ডেনিমসহ বেশ কিছু উচ্চমূল্যের পোশাক ক্রেতা মেলায় এসেছে। এর পাশাপাশি কিংপিনস শো নামের একটি পোশাক মেলা আয়োজক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ড্রু ওলাহ ডেনিম এক্সপোতে এসেছেন। ফারুক হাসান বলেন, ‘যারা বাংলাদেশে আসার কথা চিন্তাও করত না, তারাও এখন বাংলাদেশমুখী।’ ডেনিম এক্সপোতে বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, তুরস্কসহ ১২টি দেশের ৪০টি কম্পানি অংশ নিয়েছে। আজ ওই প্রদর্শনী শেষ হবে।