হাসান সোহেল : গার্মেন্টস শিল্পের সাফল্যের পর বিশ্ববাজারে ওষুধ শিল্পের সাফল্যের দুয়ার খুলে যাচ্ছে। গার্মেন্টস পণ্য রফতানী করে যেমন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে; দেশে ৪০ লাখ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তেমনি বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, হংকং, জাপানসহ বিশ্বের ১০৭টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১৭ বছর ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশের মেধাস্বত্ব আইন মানার বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকছে না। ডব্লিউটিও’র এ সিদ্ধান্তের প্রাণ ফিরে পাবে দেশের ওষুধ শিল্প। ওষুধের উৎপাদন এবং রফতানী বাড়বে; আরো কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার নারী-পুরুষের। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেন, শুধু ওষুধের স্যাম্পল রফতানি করেই ওষুধ শিল্প এতোদূর এসেছে। এখন পোশাক শিল্পের পরই ওষুধ রফতানি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে। প্রফেসর ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডব্লিউটিও’র এ সিদ্ধান্ত আমাদের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওষুধ শিল্প নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের মতে, ডব্লিউটিও ওষুধ শিল্পকে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। দেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানির মাধ্যমে বিশ্ববাজার থেকে হাজার হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ রয়েছে। তাদের মতে, উচ্চমানের ওষুধ প্রস্তুতকরণ, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের ক্ষেত্রেও এ শিল্প বিশ্বের কাছে নিজেদের সক্ষমতা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে। তাই বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা আর বিশ্ব বাজারের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ওষুধ রফতানিতে এশিয়ার তথা বিশ্বের শীর্ষ কয়েকটি দেশের তালিকায় উঠে আসার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। এতে করে দেশে প্রয়োজনীয় ওষুধের শতভাগ চাহিদা পূরণ যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি স্বল্পমূল্যে ওষুধের সরবরাহেরও সুযোগ মিলবে। তাই এখন কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। তবে অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে নির্মাণাধীন ওষুধ শিল্প পার্ক স্থাপনের কাজ শেষ না হওয়ায় অনেকটা হতাশা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা অবিলম্বে এই পার্কসহ ওষুধ শিল্পের অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দূর করার তাগিদ দেন। গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ডব্লিউটিও’র এ সিদ্ধান্ত আমাদের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এ জন্য যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা চিহ্নিত করে এর সঠিক সদ্ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের বাইরে ওষুধ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জনকারী দেশ নেই। তাই আমাদের জন্য বড় সুযোগ। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই সুবিধা গত ১৪ বছর ধরেও বাংলাদেশের জন্য ছিলো। কিন্তু গুরুত্ব না দেওয়ায় আমরা সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশে এখন বিশ্বমানের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের ১০৭টি দেশে আমাদের ওষুধ রফতানি করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জন্য এক বড় প্রাপ্তি। তিনি দাবি করেন, দেশ শুধু পোশাক শিল্পের ওপরই নির্ভরশীল নয়, ওষুধ শিল্পও পরিপূরক হয়ে উঠছে। দেশের শীর্ষ স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মোক্তাদির ইনকিলাবকে বলেন, গার্মেন্টস বা অন্য কারো সঙ্গে তুলনা নয়, তবে ডব্লিউটিও’র এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য বড় একটি সুযোগ। এটাকে কাজে লাগিয়ে যতদূর এগিয়ে যাওয়া যায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, শুধু ওষুধের স্যাম্পল রফতানি করেই যে শিল্প এতোদূর এসেছে, সেই শিল্প নিয়ে অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন আমরা বুনতেই পারি। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সূত্র মতে, এক সময়ে দেশের চাহিদার ৭০ ভাগ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। দুই একটি কঠিন রোগের ওষুধ ছাড়া বর্তমানে সেই আমদানি নির্ভরতা নেই বললেই চলে। একই সঙ্গে বর্তমানে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ১৩ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ বাজারকে ছাড়িয়ে প্রতিবছর বিশ্বের ১০৭ টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে দেশের তৈরি ওষুধ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত বছর বাংলাদেশ ৭২ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ রফতানি করেছে। চলতি বছর এর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করা হয়েছে ৮০ মিলিয়ন ডলারে। আগামী ১০ বছর এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের ওষুধ খাতের রফতানি বাজার ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪টি ওষুধ কারখানা সচল রয়েছে। এসব কোম্পানি সম্মিলিতভাবে প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে। যার মধ্যে বড় ১০টি কোম্পানি দেশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। বড় ২০টি কোম্পানি বিবেচনায় নিলে তারা মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ সরবরাহ করছে। আর ৪০টি কোম্পানি ১৮২টি ব্র্যান্ডের সহস্রাধিক রকমের ওষুধ রফতানি করে। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ১০টি দেশ ওষুধের আকর্ষণীয় বাজারে পরিণত হবে। এগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ভারত, রাশিয়া ও কানাডা। এর মধ্যে চারটিতে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার রয়েছে। বাকি ছয়টিতেও শিগগিরই প্রবেশাধিকারের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। কারণ বিশ্বে ওষুধের জন্য এখন বার্ষিক ব্যয় ৯৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, যা ২০১৬ সাল নাগাদ এক লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে। সেখানে বাংলাদেশের ওষুধের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকবে। এদিকে বাংলাদেশ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওষুধ আমদানির জন্য গত বছরের ২৩ জুন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বিকাশে যা একটি বড় ধরনের উদ্যোগ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে ৫২৫ ধরনের ওষুধ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। একই সঙ্গে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর বেলারুশের প্রধানমন্ত্রী ড. মিখাইল ভি মিয়াসনিকোভিচ বাংলাদেশ থেকে ওষুধ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এছাড়া এ বছরের ২৪ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার হাইকমিশনার জিওফ কিউ.এম. ডয়েজ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানি বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি সংসদে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ বিশ্বের ১০৭টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। অনুন্নত বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, হংকং, জাপান ও ডেনমার্কের মতো দেশে ওষুধ রফতানি করা হচ্ছে। মন্ত্রী আরও বলেন, ওষুধের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে বিনামূল্যে নমুনা প্রেরণের সুবিধা দেয়া হচ্ছে।ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র মতে, গেল বছর ওষুধ রফতানিতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ছিল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। কোম্পানিটি এ সময় ১৩৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ওষুধ রফতানি করে। এছাড়া ১০০ কোটি ৫০ লাখ টাকার ওষুধ রফতানি করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ৮২ কোটি ২২ লাখ টাকার ওষুধ রফতানি করে তৃতীয় অবস্থানে আছে নোভার্টিজ বাংলাদেশ লিমিটেড। এদিকে ডব্লিউটিও’র মেধাস্বত্ব আইন মানার বাধ্যবাধকতা না থাকায় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের জন্য যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। যে কারণে গত ১৪ বছর এই সুবিধা ভোগ করেও ওষুধ শিল্প যে স্থানে যাওয়া দরকার ছিলো, তা পারেনি। এখনো দেশে উৎপাদিত অধিকাংশ ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সূত্র মতে, উৎপাদিত ওষুধের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশই আমদানি করতে হচ্ছে। তাই সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ধরা হচ্ছে- কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নির্মিত শিল্প পার্কের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়াকে। ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জনে এই শিল্প পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এ শিল্প পার্ক স্থাপনের পর কাঁচামাল উৎপাদনে উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তি সহায়তা পাওয়া যাবে বলে প্রতিশ্রুতি রয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এ শিল্প পার্কের কাজ শেষ করতে ইতোমধ্যে তিন দফা সময় বাড়ানো হয়েছে। গত জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো এর অনেক কাজ বাকি বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট’ বা এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপন কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৮ সালে। প্রায় ২০০ একর জমিতে প্রকল্পটির তত্ত্বাবধান করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। উল্লেখ্য, ডব্লিউটিও ১৯৯৫ সালে ট্রিপস চুক্তি সম্পাদন করে। এ চুক্তির মাধ্যমে ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট ডিজাইনসহ মেধাস্বত্বের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। চুক্তির মধ্যে ওষুধের পেটেন্ট সংক্রান্ত বিধিবিধান রয়েছে। তখন ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রডাক্ট পেটেন্ট দেয়ার বিষয়টি উঠে আসে। অর্থাৎ যে ওষুধটি প্রথম যে দেশে উৎপাদন হবে, তাদের ২০ বছর পর্যন্ত পেটেন্ট সুবিধা দিতে হবে। ওই সময় বিশ্বের গরীব দেশের লোকজনের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়। পরে ২০০১ সালে ট্রিপস অ্যাগ্রিমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিষয়ক দোহা ঘোষণা অনুযায়ী, ২০০২ সালে প্রথম মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়। ওই বছর ডব্লিওটিও সাধারণ অধিবেশনে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য এই সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করে। সম্প্রতি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য নতুন করে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে ছাড় দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। আগামী মাসের ১৫-১৮ ডিসেম্বর নাইরোবিতে অনুষ্ঠেয় ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ সম্মেলনে দ্বিতীয় মেয়াদে মেধাস্বত্ব ছাড়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। এর ফলে বাংলাদেশ আরও ১৭ বছর মেধাস্বত্বের জন্য কোনো ব্যয় না করেই ওষুধ তৈরি ও কেনা-বেচা করতে পারবে। – See more at: