উন্নয়ন ও রাজনীতি:চেতনায় বাংলাদেশ

লেখক: তৌহিদুল হক সহকারী অধ্যাপক সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ট্রেজারার, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ভিকটিমোলোজি এন্ড রেস্টোরেটিভ জাস্টিস e-mail: tawohid@gmail.com

রাজনীতি হলো সকল ধরনের উন্নয়নের হাতিয়ার বা শক্তিশালী প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়া সময়ের সাথে তাল রেখে উন্নয়ন কাঠামো নির্ধারণ করে। সময়ের আদলে বদল হয় মানুষের মজ্জাগত উপকরণ যা জীবন, সমাজ, সমষ্টির সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে তৈরি করে নতুন আঙ্গিকের বিছানা, যে বিছানা সমাজ রাজনীতির বেষ্টনীতে নিরাপদ হবে, হবে সকলের উপযোগ্য। রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তি ও বাংলাদেশে এর চর্চা এ দু’য়ের মধ্যে ফারাক বেশি, মিল কম। সম্ভবত এই কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ‘রাজনীতি’ হয়ে ধরা দেয় না। বাংলাদেশে অস্থিরতাই যেন সুস্থতার লক্ষণ। রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তির পরিচয়ে বলা যায়, রাজনীতি হল সকল ধরনের উন্নয়নের সেই মন্ত্র যে মন্ত্রে উজ্জীবিত হবে ব্যক্তি। ব্যক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ব্যক্তির ওপর ভরসা করা যায়। কারণ ব্যক্তিই সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ডের সচল কর্মীয় পরিবহন, যে বহনে রাষ্ট্রের সকল অরগান নিরাপদ থাকবে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নের মডেল’ হিসাবে পরিচিত, যে উন্নয়ন মডেল অন্য দেশগুলো ব্যবহার করতে পারে। সময়ের পাল্লায় বর্তমান বাংলাদেশের বয়স চুয়াল্লিশ বছর। এই চুয়াল্লিশ বছরে আমাদের বহুদূর যাওয়ার কথা, আমরা যেতে পারিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিই উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রক্রিয়া/মডেল সৃষ্টি করে সমগ্র বিশ্বের চোখে তাক লাগিয়ে দিয়েছে; প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সুস্থতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন; কারণ রাজনৈতিক সুস্থতা সকল ভালো-মন্দের পরিচালক। রাজনীতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জেগে ওঠা সম্ভব।

বাঙালি জাতির ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ ও জনককে হত্যার পর, সোজা কথায়, বাংলার রাজনীতি হয়েছে পারস্পরিক দোষারোপের বন্ধনে শিল্পরূচি বহির্ভূত রাজ-শিল্পের কারুকার্য। যা বাংলার মানুষকে যথার্থ অর্থে নিরাপদ রাখতে পারেনি। যার ধারাবাহিকতা এখনও আমরা দেখছি। পর পর দুজন বিদেশি হত্যার পর যে প্রক্রিয়ায় দোষারোপ চলছে, — সেটা সেদিকে না গিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ঘটনার সার্জারি করে মূল রহস্য উদ্ঘাটন করা উচিত আমাদের স্বার্থে, কারণ আমরা কাগজে-কলমে ও আচরণে শান্তিপ্রিয়তায় বিশ্বাসী। এই হত্যাকাণ্ড বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অনেকটা নড়বড়ে করেছে তাতে সন্দেহ নাই। তবে সময়ের দাবি হল—ঘটনার তদন্ত চাই। সময়ের প্রেক্ষাপটে ঘটনার তদন্ত ও কারণ উদ্ঘাটন প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নের সাথে ‘দাদা রাষ্ট্র’দের অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন, সাফল্য কোন একটি রাজনৈতিক শক্তির নিকট অসহ্য লাগে। বিদেশি হত্যা কিংবা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে সেই সাফল্যকে ম্লান করে দিতে চায়। আমাদের প্রত্যাশা তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা।

একজন বাঙালি হিসেবে ভাবতে ভাললাগে যে, মাঝে মাঝে বর্তমান সরকার বিশ্বরাজনীতির অনেক চাপকে উপেক্ষা করেছে যা আমাদের মান-মর্যাদা, স্বাধীন অবস্থান বিশ্বের বুকে আলাদা জায়গা করে দিয়েছে। বর্তমান সরকার পর পর দু’বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, জনগণের মধ্যে একটি পক্ষ (স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি) নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে উশখুশ করে। এটাই সুযোগ সমালোচনাকে ‘আলোচনা’য় রূপান্তরিত করা। তবে সেটি করতে হবে উন্নয়নের মাধ্যমে। ঘটনা ঘটলেই একটি পক্ষের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা নিরাপদ উন্নয়নের লক্ষ্য নয়, এটি টেকসই উন্নয়নের চিত্রও নির্দেশ করে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সঠিক উন্নয়নের। কিন্তু তাঁর সকল নির্বাচিত সংসদ সদস্য কী তাঁদের নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে তত্পর? আজকের বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করতে চাই, পাঁচ বছরে সমগ্র বাংলাদেশ চকচক করা সম্ভব নয়, তবে সামাজিক পরিমণ্ডল শান্তির অবগাহনে সাজানো সম্ভব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিনীত আবেদন ‘শ্রেষ্ঠ সংসদ সদস্য পদক’ চালু করুন। প্রতিটি এলাকার জন-চাহিদা অনুযায়ী কর্মের রোড ম্যাপ তৈয়ার করে দুর্বারগতিতে চলুক উন্নয়নের নিশানা। বাংলার মানুষ আজ কাজ দেখতে চায়, কথার বাহাদুরি অনেক হয়েছে, মানুষ আজ কথার কাব্যে বিশ্বাস রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী অনেক জায়গায় দেয়ালে লিখেছে, মননের কবি রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু, আর উন্নয়নের কবি শেখ হাসিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও উন্নয়ন ইতিহাসে আপনার ‘কিংবদন্তি’ হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। বাংলার মানুষ যে সুযোগ আপনাকে দিয়েছে, এই সুযোগ চূড়ান্ত সুযোগ, হয়তো ভবিষ্যতে কাউকে এই সুযোগ দিবে না। আপনার দূরদর্শী নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, আমরা জানি আপনি প্রস্তুত, কিন্তু আপনার দলের সকল সদস্য কী প্রস্তুত? কিংবা যারা উন্নয়ন বিরোধী তাদের প্রতিরোধে সরকার কী প্রস্তুত? বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কর্মের মাধ্যমে পুরোপুরিভাবে প্রমাণ করেছেন, আপনার চেতনায় বাঙালি, স্থিরতায় বাঙালি, কর্মের ও ধর্মের আয়োজনে বাঙালি, তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন। বাংলার মানুষ আজ দিনবদলের স্বপ্ন আপনার মাধ্যমে দেখতে পায়। এগিয়ে চলুক বর্তমান উন্নয়নের কর্মধারা।

বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন পরিসংখ্যানিক সূচকে বেড়েছে কিন্তু ‘মানবিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা বা মানুষকে প্রকৃত ‘মানুষ’ হওয়ার উন্নয়ন কতটা হয়েছে? মানবিক সমাজ তথা মানবিক মানুষ তৈরি এখন বড় চ্যালেঞ্জ? আমাদের দেশের রাজনৈতিক কর্ম-চিন্তায় যে বিষয়টি বার বার উঠে আসছে তাহল, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা দেশ শাসন করছে। ভাবুন, গণতন্ত্রে শাসন করা যায় কি না? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হলো সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া। আর শাসন হল স্বৈরতন্ত্রের মূল দর্শন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি দেশ ও মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে রাজনীতি ও উন্ননের ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ হবেন- এটাই আজ প্রত্যাশা। আপনি বাংলার মানুষের মধ্যকার গালাগালিকে যদি কোলাকুলিতে পরিণত করতে পারেন; তবেই ইতিহাসে আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দু’টি পুরস্কার লাভ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে, আর এ সম্মান, পুরস্কার বাংলার মানুষকে উত্সর্গ করে বাংলার মানুষের জাতিগত আনন্দ বৃদ্ধি করেছেন। বর্তমানে দেশে সামাজিক অস্থিরতা বেশি, যে অস্থিরতা উন্নয়নের বড় বাধা। সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধ, নৈরাজ্য, প্রভৃতি বন্ধে ‘দ্রুত বিচার সংস্কৃতি’ চালু করুন। কারণ বিচারহীনতা অপরাধের সংখ্যা ও মাত্রা বাড়ায়। তবে অতীতের বিচারহীনতার সংস্কৃতি অনেকটা কমেছে, বিচার হচ্ছে; তবে প্রক্রিয়া শিথিল। তবে প্রক্রিয়া যতো গতিশীল হবে মানুষে মানুষে বন্ধন ততো বাড়বে। আর বন্ধন যতো বাড়বে উন্নয়নের চাকা ততোই ঘুরবে। উন্নয়ন তত্ত্ব এটাই বিশ্বাস করে। এখন প্রশ্ন হলো— আমরা এই বিশ্বাস থেকে কতটা দূরে বা কাছে? সম্প্রতি একজন সংসদ সদস্যকে কারাগারে প্রেরণ তথা বিচারের মুখোমুখিকরণ অপরাধের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ এর দৃষ্টান্ত। বাংলার মানুষ এটাই চায়। বাংলার মানুষ দেখতে চায় সংবিধানে বর্ণিত সেই ধারার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন; যেখানে বলা হয়েছে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ক্ষমতা নির্বিশেষে কোনরূপ বৈষম্য নয়। সবাই সমান- এটা বলা সহজ, কিন্তু মানা কষ্টকর। বাংলার মানুষ আজ সার্বিক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ পদ্ধতির কার্যকরি বাস্তবায়ন দেখতে চায়।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি এক ভাষণে বাংলাদেশের রাজনীতির সার্বিক অবস্থা একটি উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ তাঁর এই বক্তব্যের জন্য। তিনি বলেছেন, রাজনীতি আজ ব্যবসায়ীদের পকেটে। ব্যবসায়ীরা এক পকেটে ‘রাজনীতি’, অন্য পকেটে ‘ব্যবসা’ নিয়ে রাজনীতির পরিবেশকে কুক্ষিগত করতে চায়, এমনকি অনেকটা করছে। তাহলে প্রশ্ন হলো রাজনীতিবিদরা কী নিজেদের জায়গা ব্যবসায়ীদের নিকট ছেড়ে দিচ্ছে। এর কারণ কী? রাজনীতিবিদরা কী নিজেদের রাজনীতিতে অতীতের মত দক্ষ মনে করছে না। না, ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে ‘পাকাপিশু’ অর্থাত্ অতি দক্ষ হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্তকরণ কোন দোষের নয়, তবে রাজনীতিকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার দোষের, বেদনার; যে বেদনার মাশুল দিতে হয় সবাইকে।

রাজনীতি যদি রাজনীতিবিদদের হাতে না থাকে তাহলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা তথা আপনি যা চাচ্ছেন তা হবে না। কারণ ডাক্তারের কাজ আইনজীবী দিয়ে সম্ভব নয়, অনুরূপ আইনজীবীদের কাজ ডাক্তার দ্বারা সম্ভব নয়। রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকরণের মধ্য দিয়ে নেতা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকরণের বড়ই আকাল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেতা তৈরি করুন। রাজনৈতিক গোলাম নয়। নেতা আপনাকে অবস্থার সঠিক বিচারে সহযোগিতা করবে, গোলাম ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার কূটচাল চালবে। বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন নিয়ে দেশের মধ্যে ও বাইরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে— এটি অবস্থা দেখলে অনেকটা বোঝা যায়। তবে জনগণ জানতে চায় কারা এই ষড়যন্ত্রের মূলহোতা। আকার-ইঙ্গিতে দোষারোপ করা উন্নয়নের ইতিবাচক নির্দেশক নয়, বরং সঠিক অবস্থা জনগণের নিকট উপস্থাপন উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে। বাংলার মানুষ আজ কাজ দেখতে চায়, মানুষ চায় বাংলাদেশ হবে সেই দেশ যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল দার্শনিক ভিত্তির সর্বোচ্চ পরিচর্চা হবে। আর বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ সতর্কতা ও দক্ষতার সাথে এটি করবে- যা বাংলার মানুষের স্বপ্ন।