বিশ্ব পরিস্থিতি কখনো স্থির থাকে না, এগিয়ে চলে। কখনো গতি হয় মন্থর, কখনো দ্রুত। বর্তমান দিনগুলোতে যদি বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকানো যায়, তবে লক্ষ্য করা যাবে, অপসৃয়মাণ দৃশ্যপট যেন পাল্টে যাচ্ছে অতি দ্রুত। অকল্পনীয়, অসম্ভব বলে গতকালও যা মনে হয়েছে, তা যেন সম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। পরস্পর সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলোর একটাতে যখন পরিবর্তন ঘটছে, তখন অন্য ক্ষেত্রও দ্রুত পরিবর্তনের পথে যাচ্ছে। ক্রমেই যেন আরো নতুন হয়ে উঠছে এই পৃথিবী। মানুষের চিন্তা ধ্যান-ধারণা মনোভাব দৃষ্টিভঙ্গি অভ্যাস রীতিনীতি যোগাযোগ সম্পর্ক প্রভৃতি সব বিষয়ই পরিবর্তনের জোয়ারের মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে কবিগুরুর কতক কবিতার লাইনগুলো যেন আরো উদ্ভাসিত চিরসত্য হয়ে উঠছে। ‘মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্ব›েদ্ব/বাম হাতে পূর্ণ কর সুধা,/ডান হাতে চূর্ণ কর পাত্র/তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রƒপে।’ এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে আরো উন্নত অগ্রসরযোগ্য করে বিশ্ব সমাজে অবস্থান নেয়ার জন্য ‘খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান’-এর পথেই যে আরো বেশি বেশি করে যেতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্ধানের এই দুয়ারকে আরো উন্মোচিত করার জন্যই বিশ্ব পরিস্থিতি পরিবর্তনের মোটা দাগে নিম্নবর্ণিত গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
এক. বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতনের পর সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ শেষ হয় এবং আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়। এই ব্যবস্থা চিরস্থায়ী রূপ নেবে, এমন প্রচার চলতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে এমনটাও দেখা দিতে থাকে যে, বিশ্ব পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে মহাশক্তিধর আমেরিকা। বিশ্বের যে প্রান্তে যা হচ্ছে বা হবে সবটাতেই হাজির আমেরিকা এবং সব কিছু যেন চলছে তারই অঙ্গুলি হেলনে। সবচেয়ে বড় কথা, কার দোষে কি হচ্ছে তা বিবেচনায় না নিয়ে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধেও’ দেশটি দিচ্ছে নেতৃত্ব। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনেই এই মিথ যাচ্ছে পাল্টে। ইউক্রেনের পর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়ায় আইএস উৎখাতে রাশিয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ এককেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাকে তছনছ করে দিচ্ছে। এই প্রথম আমেরিকা বলছে, তারা ব্যর্থ এবং সিরিয়া নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে একত্রে কাজ করবে।
দুই. এককেন্দ্রিক বিশ্বের বাস্তবতা কেবল রাশিয়া ভেঙে দিচ্ছে এমনটা কিন্তু নয়। এশিয়াতে চীন-ভারত নতুন শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অবস্থান ও নীতি কৌশল এককেন্দ্রিক ধারণার গণ্ডিকে ক্রমেই চ্যালেঞ্জ করছে। একটা বিষয় ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, বড় ও শক্তিধর দেশগুলো ক্রমেই নিজ প্রভাব বলয়ে বিশেষত সীমানার আশপাশে অপর কোনো শক্তিধরের নাক গলানোর সুযোগ দিচ্ছে না। প্রসঙ্গত, বেশ কিছুকাল আগে ইউক্রেন সমস্যা দানা বেঁধে ওঠার সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের শেষ শাসক গরবাচভের বক্তব্য কোথায় যেন পড়ছিলাম। তিনি বলছিলেন, সোভিয়েত সীমানায় তার প্রভাবিত অঞ্চলে ন্যাটো কেন? তখনই এককেন্দ্রিক বিশ্ব যে থাকছে না সেটা অনুমান করা যাচ্ছিল। এখন বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আরো লক্ষণীয় এই যে, শক্তিধর দেশগুলোর প্রভাব বলয়ের ধারণা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো অনেক ক্ষেত্রেই মেনে নিতে চাইছে না। ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া, ঢিলের বিপরীতে পাটকিল বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। ফলে এলাকায় এলাকায় টেনশন বাড়ছে। এককেন্দ্রিক বিশ্ব একদিকে হেলে গিয়েছিল, এখন ভারসাম্য কিভাবে কখন কোন দেশকে কোন পক্ষে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে, তা কারো পক্ষেই অনুমান করা হচ্ছে শক্ত।
তিন. এককেন্দ্রিক বিশ্ব হতে যাচ্ছে বহুকেন্দ্রিক এবং এককথায় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্ব। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা আছে কি নেই, এ নিয়ে কারো পক্ষেই ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। তবে এটাই সত্য যে, এখানে ওখানে যুদ্ধ চলছেই। আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষও মরছে। সভ্যতা হচ্ছে কালিমালিপ্ত। কেবল রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নয়, একই দেশের অভ্যন্তরেও গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে এবং এ সবের শেষ পরিণতি সম্পর্কে কিছুই বলা যাচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা একদিকে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো দিয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে আর অন্যদিকে বড় বড় ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটিকে অসহায় মনে হচ্ছে এবং নীরবতা-নিষ্ক্রিয়তা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বঞ্ঝ¦াবিক্ষুব্ধ বিশ্বে পূর্বে স্থিরীকৃত সব রীতিনীতি ও আইনকানুন বাতিল হয়ে যাচ্ছে। দেশগুলোর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিশ্ব অঙ্গীকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, যখন তখন ড্রোন হামলা ইত্যাদি সংঘটিত হচ্ছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যা ছিল ঠাণ্ডা যুদ্ধ যুগে মূলত আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে সীমিত, তা এখন বিভিন্ন দেশগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।
চার. বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেই হোক আর সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের মধ্যেই হোক গণতন্ত্র যেন বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অসামঞ্জস্যতা ও বৈপরীত্যের মধ্যে হাবুডাবু খাচ্ছে। পরমত সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা ক্রমেই যেন হ্রাস পাচ্ছে এবং গণতন্ত্র প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠানিক না হওয়ার উপাদানগুলো যেন বাড়ছে। উগ্র ধর্মীয় মতবাদ ক্রমে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের একাংশকে যেন রেষারেষি, হিংসা, দ্বেষ প্রভৃতি দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখছে এবং এতে সহিংসতা ও উগ্রতা ক্রমে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। মতামত আদান-প্রদানের স্বাধীনতা, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, চলাচল ও যোগাযোগের স্বাধীনতা, জাতিতে জাতিতে মিলন-সংশ্লেষণ প্রভৃতি যত বাড়ছে, ততই যেন উল্টো দিকে আরষ্ট অন্ধ অনড় মৌলবাদী ধরনের চিন্তাধারণা বিভিন্ন ধর্মমতের একাংশের মানুষকে অন্ধ করে দিচ্ছে। উদারনীতিবাদ এখন পেন্ডুলামের মতো দুলছে এবং কখনো মনে করছে পোষ মানিয়ে তাঁবুর ভেতর রাখতে হবে সন্ত্রাসকে আবার কখনো সমূলে উৎপাটন করতে চাইছে। উদারনীতি ও অন্ধত্ব- পাশাপাশি ও বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে অসামঞ্জস্যতাকে ক্রমে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পাঁচ. উঠতি-পড়তি ঢেউ বিশ্ব অর্থনীতিকেও অস্থির করে তুলছে। এটা জানার মধ্যেই ছিল যে, অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকটের পেছনে পেছনে আসে রাজনৈতিক সংকট-ঝঞ্ঝা ইত্যাদি। বিশ্ব মন্দার কাল কেটে গেছে নাকি এখনো কাটেনি, কোন দেশ কখন কিভাবে মন্দা ও সংকটে পড়বে, তা অনুমান করা হচ্ছে কঠিন ও জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজনীতি যেহেতু অর্থনীতির উপরি কাঠামো, তাই অর্থনীতি সেই অর্থে স্থিতির একটা পর্যায়ে না গেলে বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, তা অনুমান করা যাচ্ছে না। প্রসঙ্গত, অর্থনৈতিক সংকটের পরিণতিতে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে গিয়েছিল, ঠাণ্ডাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জের পতনের পরও একই ঘটনা ঘটেছিল; এখন অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকট কেটে গিয়ে স্থিতির এক অবস্থা না আসা পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারা বোধকরি যাবে না, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল কি রূপ নিয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বিশ্ব অর্থনীতিতে কি পরিবর্তন আনতে পারে এবং রাজনীতিতে কি প্রভাব পড়বে; তা বুঝে উঠতে পারা এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে কোনো দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে যেমন যাচ্ছে, ঠিক তেমন মাথা তুলে দাঁড়ানো অর্থনীতির দেশও বিশ্ব দরবারে ক্রমেই স্থান করে নিচ্ছে।
ছয়. অর্থনীতির দিকটা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, মূলত ও প্রধানত দুটো দিক মূল্যায়নে উঠে আসছে। প্রবৃদ্ধি বাড়ার বিষয়টাই কেবল আলোচনায় থাকছে না। মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থাটা কোন দেশে কী তা ক্রমেই সামনে আসছে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল যখন টেকসই ডেভেলপমেন্টের পথে যাচ্ছে; তখন গরিবী বিশ্বব্যাপী এবং কোন দেশে কতটা কমছে বা বেড়েছে, তা বিবেচনায় আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে বৈষম্য কেবলই বাড়ছে। যথেচ্ছ ও অপরিমিত ব্যবহারের কারণে পরিবেশ প্রতিশোধ নিতে পারে বিবেচনায় এই বিষয়টা ক্রমেই আরো সামনে আসছে। একটা বিষয় ক্রমে রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ‘যাবে তুমি নিচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে।’ ইউরোপের শরণার্থী সমস্যা কিংবা বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরে ভাসমান শরণার্থী সমস্যা ক্রমেই এটা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, আনবিক বোমাই কেবল নয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য কিংবা রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতাও এক ধরনের বোমা; যা ছোটকেই কেবল ব্যথা বেদনার মধ্যে ফেলে দেয় না, বড়দেরও এ থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। ‘বিশ্বগ্রাম’-এর এক স্থানে যদি লাগে আগুন, তবে বড়-ছোট কারো রক্ষা নেই তা থেকে। বস্তুতপক্ষে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার কথা বিভিন্ন দেশে নানাভাবে আরো সামনে এলেও এটাও ঠিক যে, পুরনো তত্ত্ব-মত থাকছে পরে, নতুন পরিস্থিতিতে সামনে আসছে নতুন চিন্তাধারণা।
সাত. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি ও উন্নতির বিষয়টা বিশ্বকে আরো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা কার না জানা যে, বিজ্ঞানের উন্নতি ও অগ্রগতি মানুষের জীবনধারণের মানই কেবল পাল্টায় না, উৎপাদন ব্যবস্থাসহ চিন্তা ধ্যান ধারণাকেও পাল্টে দেয়। শিল্প বিপ্লব না হলে সামন্ততন্ত্রের পতন হতো না, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিপ্লব না হলে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতন হতো না। বর্তমান দিনগুলোতে বলা যায় খুব কম সময়ের ব্যবধানে ঘটে যাচ্ছে নানা বৈজ্ঞানিক বড় বড় আবিষ্কার। মঙ্গলে মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান গড়ার প্রচেষ্টা, সবচেয়ে দূরের বামন গ্রহ প্লুটোতে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধান চালানো, আমাদের সৌর জগতের অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা কিংবা অন্য কোনো গ্রহান্তর থেকে এলিয়েন পৃথিবীতে আসবে কিনা প্রভৃতি নিয়ে নব নব অবিষ্কার যেন দরজায় করাঘাত করছে। জিন প্রযুক্তির অগ্রগতি, সমন্বয় ধারণা প্রভৃতি বর্তমান পরিবার সমাজ প্রভৃতি সব কিছুকে কতটা প্রভাবিত ও পরিবর্তন করবে, তা বুঝে উঠতে পারা হচ্ছে কঠিন। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র কণা জগতের নতুন নতুন আবিষ্কার সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে ক্রমে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই আবিষ্কার ও ব্যবহার রাজনীতি-অর্থনীতি-সামাজিক পরিস্থিতিতে কোন ধরনের পরিবর্তন আনবে, তা এখনো সুস্পষ্ট হচ্ছে না। এদিকে বিজ্ঞানের ব্যবহার যত বাড়ছে ততই যেন বিজ্ঞানের চর্চা যুক্তিতর্ক ও মনস্কতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এই ক্ষেত্রের অগ্রগতি-উন্নতি বিশ্ব সমাজকে বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্যতার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
ক্ষুদ্র এই কলামের সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণিত এই বিশ্ব পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতির মধ্যে আমাদের দেশ-জাতি-জনগণের জন্য রয়েছে কতক ইতিবাচক আর কতক নেতিবাচক উপাদান। আর এটাও তো বাস্তব যে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমরা বহন করে চলেছি কতক সমস্যা-সংকট তথা নেতিবাচক উপাদান। সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে জাতীয় উপমহাদেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে নানা সমস্যা-সংকট, যা আমাদের পেছনে ঠেলে দিচ্ছে; বিশ্ব অঙ্গনে সগৌবরে মাথা তুলে দাঁড়াতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থায় ‘খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান’ চেতনার দ্বারস্থ হওয়া ভিন্ন বিকল্প নেই। আমাদের জীবন ও জীবিকার মান উন্নত অবারিত ও প্রসারিত করার কাজটা হতে হবে এমন সৃজনশীল ও সুদূরপ্রসারী যে, যাতে বিশ্ব প্রেক্ষাপটের উন্নতি-অগ্রগতির ইতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে আমাদের কষ্টার্জিত ইতিবাচক দিকগুলোর সংশ্লিষ্টতা নিরবচ্ছিন্ন হয়। ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’ ধরনের কাজগুলো করাই এখন আমাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জাতি হিসেবে আমরা একাত্তরে ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগে বিশ্ব পরিস্থিতির সুযোগের সদ্ব্যবহার করে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিলাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আইয়ুবের সামরিক শাসনের মধ্যে ষাটের দশকের শুরুর বছরগুলোতেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৬১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে স্বাধীন বাংলার দাবি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাই, এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতাও (অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী সাহেব) আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই এখনকার মতো সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল’ ইত্যাদি। বস্তুতপক্ষে ধৈর্য ধরে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতি এবং মানুষের মনোভাব বুঝে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি ‘টেউ-এর ওপর দিয়ে পালের নৌকা’ চালিয়ে স্বাধীন স্বদেশ দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রবাদ বলে সুযোগ সব সময় আসে না। আর সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান। এখন সময় ও সুযোগের দুয়ার নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে উন্মোচিত হচ্ছে। তাই এখনই উচ্চকণ্ঠে বলতে হবে, ‘প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে/সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।’ জাতিকে আবারো একাত্তরের মতো প্রমাণ করতে হবে যে, বাঙালি মানুষ হয়েছে।