বিশ্বমানের হবে দেশি মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মান সনদ বিশ্বের অনেক দেশেই গ্রহণ করা হয় না। এ দেশ থেকে রপ্তানি করা পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার পরীক্ষায় যোগ্য হলেই কেবল সে দেশের বাজারে ঢুকতে দেওয়া হয়। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সংস্থার দুর্বল অবকাঠামোর জন্য বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানে এবার উদ্যোগী হয়েছে সরকার। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মান উন্নয়নে দিকনির্দেশনা দিয়ে জাতীয় গুণগত মান (পণ্য ও সেবা) নীতি ২০১৫-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। যা মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত হবে।

শিল্পমন্ত্রীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বস্ত্র ও পাট, কৃষি, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, শ্রম ও কর্মসংস্থান, পরিবেশ ও বন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কোর গ্রুপ এ নীতির খসড়া প্রণয়নে কাজ করেছে।

শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু কালের কণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এ দেশের পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়া, কারখানার পরিবেশ, পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালসহ সব বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে জাতীয় গুণগত মান (পণ্য ও সেবা) নীতি ২০১৫ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে। আশা করি অচিরেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নীতিমালা চূড়ান্ত হবে।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, শিল্প নীতি, বাণিজ্য নীতি, নিরাপদ খাদ্য নীতি এবং গুণগত মান নীতি, নিরাপদ খাদ্য আইন, ভোক্তা সংরক্ষণ আইন, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতি, জাতীয় বীজ নীতি, জাতীয় শ্রম নীতি, জাতীয় পরিবেশ নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে জাতীয় গুণগত মান (পণ্য ও সেবা) নীতির খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।

জাতীয় গুণগত মান (পণ্য ও সেবা) নীতির প্রেক্ষাপট বর্ণনায় খসড়া নীতিতে উল্লেখ আছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রবেশের অন্যতম শর্ত নিরাপদ ও নিশ্চিত পরিবেশে পণ্য উৎপাদন। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট দেশের নিয়ন্ত্রণমূলক এবং বাজারসংশ্লিষ্ট গুণগত মান, নিরাপদ স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত শর্তগুলো পূরণে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধিতে কারখানার পরিবেশ এবং পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশি পণ্য কি কাঁচামাল ব্যবহার করে এবং কোন পরিবেশে উৎপাদিত হচ্ছে তা নজরদারির মূল দায়িত্ব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর। দুর্বল কাঠামোর কারণে এখনো বাংলাদেশের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর সনদ আন্তর্জাতিক বাজারে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ দেশের নামি-দামি কারখানায় উৎপাদিত পণ্যও বিএসটিআইএসহ বাংলাদেশের অনেক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সনদ নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশির ভাগ সময় প্রবেশের অনুমতি পায় না। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মান উন্নয়নে দিকনির্দেশনা প্রণয়নে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসায়ীরা দাবি জানিয়ে আসছে। ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনায় জাতীয় গুণগত মান (পণ্য ও সেবা) নীতি ২০১৫ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বিবেচনায় জাতীয় গুণগত মান (পণ্য ও সেবা) নীতিতে এই সংস্থাগুলো পরিচালনায় একটি গাইডলাইন থাকবে।

খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বিএসটিআই এবং বিএবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সক্ষমতা এবং সামর্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। অনেক ক্ষেত্রে কারিগরি সক্ষমতার মানোন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামোর উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এসব প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিএবিকে উপযুক্ত হয়ে আইএলএসি-এমআরএ, আইএএফ-এমএলএতে স্বাক্ষরদানকারী হওয়া প্রয়োজন। বিএসটিআইয়ের সব পরীক্ষাগারকে অ্যাক্রেডিটেড হওয়া বাধ্যতামূলক। ‘

এ নীতিতে আরো উল্লেখ আছে, মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো এমনভাবে পরিচালনা করা উচিত যাতে এই সংস্থাগুলোর প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারের আস্থা ও বিশ্বাস বজায় থাকে। খসড়া নীতিতে মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসটিআই এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি), বৈজ্ঞানিক ও শিল্পসংক্রান্ত মেট্রোলজি হিসেবে বিএসটিআই, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা কাউন্সিল (বিসিএসআইআর) ও ডেজিগনেটেড রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (ডিআরআইসিএম), কাউন্সিল হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএইসি) (তেজস্ক্রিয়তা মাত্রা পরিমাপের জন্য), আইনি পরিমাপে বিএসটিআই, পরীক্ষণ ও ক্যালিব্রেশন পরীক্ষাগারের অ্যাক্রেডিটেশন প্রদানে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড (বিএবি) নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরো ছয়টি প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করা হয়েছে। কারখানার পরিবেশ, উৎপাদন, মোড়কজাতকরণ, বিক্রিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্যও জাতীয় গুণগত মান (পণ্য ও সেবা) খসড়া নীতিতে একগুচ্ছ নির্দেশনা রয়েছে।

বিএসটিআই সম্পর্কে উল্লেখ আছে, ‘জাতীয় মান সংস্থা হিসেবে বিএসটিআইয়ের দায়িত্ব হচ্ছে খাদ্য ও কৃষিপণ্য, রাসায়নিক পণ্য, পাট ও বস্ত্রপণ্য, ইলেকট্রনিকস, বৈদ্যুতিক ও প্রকৌশলী পণ্যসহ বাজারের ১৫৫ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আবশ্যিক মান নির্ধারণ করা। বিএসটিআই কর্তৃক নির্ধারিত মান অনুযায়ী দেশি-বিদেশি বাজারে বিক্রি হচ্ছে কি না তাও তদারকি করবে বিএসটিআই। একই শ্রেণির আমদানিকৃত পণ্যের পরিদর্শন ও ছাড়পত্র প্রদান করবে। বিএসটিআই বাংলাদেশে ওজন ও পরিমাপসংক্রান্ত আইন ও বিধি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।’

খসড়া নীতিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নীতিতে উল্লেখ আছে, ‘পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত কিছু দায়িত্বের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের দূষণ ও অবক্ষয়মূলক কর্মকাণ্ড শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে। কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা করবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নিয়মিত নজরদারিতে আগে স্থাপিত শিল্প-কারখানার পরিবেশ দূষণ দূর করতে পর্যায়ক্রমে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেবে। নতুন স্থাপিত শিল্প-কারখানায় পরিবেশের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি করবে। পরিবেশ দূষণ করে এমন পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প স্থাপন নিষিদ্ধকরণ ও স্থাপিত শিল্প পর্যায়ক্রমে বন্ধ করবে। পরিবেশসম্মত বিকল্প উদ্ভাবন ও প্রচলন উৎসাহিত করা, শিল্প কাঁচামাল অপচয় রোধ ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ নীতি অনুসরণ করা। শিল্প কারখানায় সঠিকভাবে বায়ু নির্গমন, পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ করবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। শুধু পণ্য উৎপাদনই নয়, পণ্য মোড়কজাতকরণ, বিক্রিতেও মানসম্মত পরিবেশ মেনে চলা হচ্ছে কি না তাও নজরদারি করতে হবে। ‘ এভাবে গুণগত মান নীতির খসড়ায় থাকছে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের আওতা।
– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/industry-business/2015/10/14/278757#sthash.TyYZ0k0s.dpuf