বাংলাদেশের ভাবমূর্তি :সাফল্য ও সংকট

লেখক: ড. রাশিদ আসকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক

বাংলাদেশ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো কোনো দেশ নয়। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে- কোনো শান্তি চুক্তির মধ্যে দিয়ে নয়। সেই স্বাধীনতা অর্জন থেকে শুরু করে অধুনা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি সাফল্য বাংলাদেশকে কিনতে হয়েছে বেশ চড়া দামে। তবুও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। তবে থামাবার চেষ্টা হয়েছে বারবার। পিতৃহত্যার মাধ্যমে এতিম করবার চেষ্টা হয়েছে; আদর্শ হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যহীন করবার চেষ্টা হয়েছে; অর্থনীতি হত্যার মাধ্যমে ভিক্ষুক বানাবার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু কোনোটাই সম্ভব হয়নি। শত সংকটের ভেতরেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ম্লান হয়ে যায়নি। দেশি-বিদেশি রকমারি চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গ্রহের বুকে। প্রতিদিন নিত্যনতুন সাফল্য বগলদাবা করছে। স্বাধীনতা-উত্তর ৮০০ কোটি টাকার বাজেট এখন প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। ৫ হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি চার দশকে ৮ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপির বিচারে ৪৪তম, ক্রয় ক্ষমতার (পিপিপি) বিচারে ৩৩তম এবং প্রবৃদ্ধিতে ৫ম স্থানে উন্নীত হয়েছে। ২০৫০ সালে খোদ পশ্চিমা অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাসও পাওয়া যাচ্ছে। সহযাত্রী নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে অনেক আগেই পিছে ফেলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বেশিরভাগ সূচকেই বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়াকে। বাংলাদেশের এই অসামান্য আর্থিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এশিয়া অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এটি নিশ্চয়ই এক বড় স্বীকৃতি।

শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক রাজনৈতিক এমনকি সামরিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আশাব্যঞ্জক। সামাজিক উন্নয়নের প্রায় অধিকাংশ সূচকেই বাংলাদেশ ভারতের চাইতে এগিয়ে আছে। ভারতে এখনোও প্রকাশ্য দিবালোকে গণধর্ষণ হয়, ডাইনী পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অথচ বাংলাদেশে সরকার প্রধান নারী, বিরোধী দলীয় প্রধান নারী, সংসদ-স্পিকার নারী, বিচারপতি নারী। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবদান অসামান্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-বিরোধী রাজনীতিতে প্রায় সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও পুরো আফ্রিকায় জাতিসংঘ পরিচালিত শান্তিরক্ষা মিশনে-অসাধারণ সাফল্য দেখিয়ে বিশ্বের ৫৩তম সামরিক শক্তি হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালের বিজয় দিবসে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উেক্ষপণের সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে চলেছে আমাদেরই বাংলাদেশ।

এভাবে একের পর এক উন্নয়নের ইট গেঁথে যখন সাফল্যের সৌধ গড়ে তুলছে বাংলাদেশ তখন ১৬ কোটি মানুষের শ্রমে ও ঘামে তিলে তিলে গড়ে তোলা এ ভাবমূর্তি বিসর্জন দেয়ার পাঁয়তারা করছে দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল। আজ বাংলাদেশে বিদেশিদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। একথা ঠিক যে, মাত্র সপ্তাহ ব্যবধানে দুই জন বিদেশির নিহত হওয়ার ঘটনা অগ্রাহ্য করার মতো নয়; কিন্তু তাই বলে, এর ফলে বাংলাদেশের সমগ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিদেশিদের অবস্থানের জন্য সম্পূর্ণ স্বনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়েছে- তেমনটি ভাবাও মনে হয় ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। মানছি গুলশানের কূটনৈতিক জোনে খুন হওয়া ইতালিয়ান নাগরিক তাভেল্লা সেজার এবং রংপুরের গ্রামীণ জনপদে খুন হওয়া জাপানি নাগরিক কুনিয়ো হোশি হত্যাকাণ্ড আমাদের ত্রুটিপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি ভ্রূকুটি করছে। তবে সেজন্য হত্যারহস্য উদ্ধার এবং পুনঃহত্যা প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থার কমতিও দেখা যাচ্ছে না। একেবারে সীমিত নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে দেশের প্রায় সোয়া দুই লাখ বৈধ এবং অসংখ্য অবৈধ বিদেশির নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাজ্যের নতুন সতর্ক বার্তা, নির্বিচারে হামলার আশঙ্কা, কিংবা আরো পশ্চিমা নাগরিক খুন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ যতোটা না যুক্তিসঙ্গত, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবমূতি-হানিকর হয়ে পড়েছে। কারণ, বাস্তব পরিস্থিতি যতোই স্বাভাবিক মনে হোক না কেনো, নিজ নিজ দেশের সদর দপ্তরের নির্দেশে বিদেশিরা নিজেদের গুটিয়ে নেয়া শুরু করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সফর বাতিলের পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের মধ্যে জরুরি প্রয়োজন না-থাকা বিদেশিদের ইতোমধ্যে স্ব স্ব দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাপান ও স্পেনসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং কানাডাসহ অনেক পশ্চিমা দেশই স্ব স্ব নাগরিকদের গতিবিধি সীমিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য হুমকি স্বরূপ।

এসব মোকাবিলায় বাংলাদেশও তো একেবারে হাত গুটিয়ে বসে নেই। কূটনীতিকদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে। কূটনৈতিক পাড়াগুলোতে ব্যাপক নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে, চিরুনী অভিযান চালানো হচ্ছে, ফলে পুনঃহত্যার সম্ভাবনা কমে আসছে। এতো কিছুর পরও ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ব্রিটিশ ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বশেষ সতর্ক বার্তায় দেশটিতে সন্ত্রাসবাদী হামলার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে বলা কতখানি অভিপ্রেত। শুধু তাই নয়, নিহত বিদেশিদের হত্যাকাণ্ডে ইঙ্গ-মার্কিন কর্তৃপক্ষ আইএসআই (ISI) জঙ্গিদের গন্ধ শুঁকবার চেষ্টা করছেন। (ISTE) ইনটেলিজেন্স গ্রুপের পরিচালক জনৈক রিটা কাটজের একটি টুইটার মেসেজের ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমারা বাংলাদেশে আইএস উপাদানের উপস্থিতির সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং তাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রমাদ গুণছেন। বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়াবার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে অজিরা তাদের নির্ধারিত ক্রিকেট ম্যাচ প্রত্যাহার করেছে। পশ্চিমা রেড এলার্টের কারণে টুরিজম শিল্প বাঁধাগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগ-ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে এবং দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।

এখন প্রশ্ন হলো- সত্যিই কি বাংলাদেশেও আইএস জঙ্গিরা ঢুকে পড়লো? দুই বিদেশি খুন হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরকম দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কি ঠিক? এ ঘটনা যে সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্রের কর্মকাণ্ড, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিংবা কোনো উগ্রপন্থি জঙ্গির কাজ তাও মানার পেছনে গ্রহণযোগ্য কারণ দেখানো যেতে পারে; কিন্তু মূলত ইরাক এবং সিরিয়া, বড়োজোর লেভেন্ট অঞ্চল কেন্দ্রিক ‘খেলাফত রাষ্ট্র’ প্রত্যাশী জঙ্গিরা তাদের ঘোষিত মিশন সফল করবার আগেই বাংলাদেশে পাড়ি জমাবে- এমনটি কোনো বুদ্ধিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে হয় ভাবতে পারবেন না। তাছাড়া এমনিতেই আইএস জঙ্গিরা বর্তমানে পুতিন বাহিনীর মুহুর্মুহু বিমান হামলায় বিপর্যস্ত এবং আত্মরক্ষা প্রবণ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে যে উগ্রপন্থি মৌলবাদীরা ছিলো তারাই কমবেশি রয়ে গেছে এবং বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে সহিংস হয়ে দেখা দিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করবার সময় এলেই তারা নতুন করে সহিংস হয়ে ওঠে। এটি অনেকবার দেখা গেছে। তবে এবারের টার্গেট বিদেশি হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা ঘোলাটে হয়েছে। পশ্চিমা বিদ্বেষী আইএস কিংবা বোকো হারামের সম্পৃক্ততা খোঁজার চেষ্টা চলছে। তা চলুক। তবে স্বদেশি জঙ্গিরাও যে এমন দুষ্কর্ম ঘটাতে সিদ্ধহস্ত, তাও বিস্মৃত হলে চলবে না। বাংলাদেশিদের হত্যা করে উদ্বেগ বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া যায় না বলেই হয়তো তারা এবারে, ঠিক মুজাহিদদের মৃত্যুদণ্ডের ঘণ্টাধ্বনি বাজার কালে ঘোলা জল সৃষ্টি করে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে নিরীহ বিদেশিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশ্বকে বোঝাতে চাইছে যে, বাংলাদেশও পাক-আফগানদের পথে পা বাড়িয়েছে।

তবে দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কার্যকারণ সন্ধানে গ্রহ চষে বেড়ানোতে দোষের কিছু নেই। এতে আইএস-এর সম্পৃক্ততা প্রমাণ হলেও তেমন কিছু এসে যায় না, বরং বাংলাদেশে আইএস-এর বীজাণু অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা যায়। তবে সমস্যা হলো- বিদেশি হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি করা। তদন্ত কাজ চলাকালে প্রায় সব মহলই নিজ নিজ স্বার্থবৃদ্ধির জায়গা থেকে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছে। সবচাইতে নেতিবাচক হলো পশ্চিমাদের রেড এলার্ট জারি। পশ্চিমা বিশ্বে কি কোনো বিদেশি খুন হয় না? অথচ বাংলাদেশের দুই জন বিদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতে রং চড়িয়ে তারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চাইছে। বিদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সব বিচারেই একটি বড়ো মাপের সন্ত্রাসী ঘটনা। এ ধরনের টেরোরিজমকে প্রতিহত করার জন্য সর্বোতভাবে কাউন্টার টেরোরিজম টুলসগুলোকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। যে কোনো মূল্যে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, তৃতীয় বিদেশিটি খুন হতে যাচ্ছেন না। শত সাফল্যের ভেতরেও বিদেশি হত্যাকাণ্ড দুষ্টক্ষতের মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সে দুর্গন্ধ আরো প্রকট করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক শত্রুরা। কৃত্রিম সংকটের ছায়া দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। বিদেশি হত্যাকাণ্ড নিয়ে চলমান কূটনৈতিক রাজনীতির মুখে ছাই দিতে হলে যথাশীর্ঘ সম্ভব খুনীদের ধরতে হবে। মোটিভ উদঘাটন করতে হবে। সর্বোপরি এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখাতে হবে। সংকট উত্তরণে সাফল্যের মহিমা বাড়ে।