Auto Draft

লেখক : ড. আর এম দেবনাথ ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমরা আজকাল শুধু দেশের আয়ের হিসাব দেখতে ব্যস্ত, ব্যয়ের হিসাব নয়। যেমন বছরে আমাদের রেমিটেন্স আয় কত, রপ্তানি আয় কত—এসব খবরই প্রাধান্য পায়। এর বিপরীতে যে আমাদেরও বেশ পরিমাণের ব্যয় আছে তার খবর কে রাখে? অথচ রাখা উচিত। যে খবরটা রাখা উচিত সেটা হচ্ছে বিদেশিরা বাংলাদেশ থেকে কত ডলার বেতন-ভাতা হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে। আমি আমদানি ব্যয়ের কথা বলছি না। বলছি বহু বিদেশি বাংলাদেশে নানা ধরনের কাজ করে যেমন বাংলাদেশিরা করে বিদেশে। আমাদের লোকেরা যেমন বিদেশ থেকে ডলার পাঠায় তেমনি বিদেশিরাও ডলার পাঠায় তাদের দেশে। দুটোর যোগ-বিয়োগ করলে কী দাঁড়ায় এই হিসাব কী কখনও আমরা করি? সাধারণত না। করলে বোঝা যাবে আমাদের দেশ থেকেও কম ডলার বিদেশে যায় না। একটি কাগজে এই সম্পর্কিত একটা খবর দেখলাম। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি একটা প্রকল্প উদ্বোধন উপলক্ষে এক বক্তৃতায় একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। প্রকল্পটির নাম ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম।’ এই প্রকল্প উদ্বোধন কালে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিদেশিরা তাদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। অর্থমন্ত্রীর তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও। একটি রিপোর্টে দেখলাম ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বিদেশিদের প্রেরিত ডলারের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে যা স্বাভাবিক। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিদেশিরা তাদের রোজগারের ডলার কামিয়েছেন ২৮৯ কোটি ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১০ কোটি ডলার। আশি টাকা দরে ৪১০ কোটি ডলারের মূল্য হয় ৩২,৮০০ কোটি টাকা। ভাবা যায় ৩২,৮০০ কোটি টাকা বিদেশে চলে গেছে কেবল মাত্র ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। ডলারের হিসাবে একে চার বিলিয়ন বা চার হাজার মিলিয়ন ডলার ধরে তুলনা করলে মজার বিষয় ধরা পড়ে। যেমন খবরে দেখতে পাচ্ছি গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি হয়েছে এক দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের। যদি এর সাথে বিদেশিদের প্রেরিত ডলারের তুলনা করি তাহলে বলা যায় দুই মাসের পোশাক রপ্তানির সমপরিমাণ ডলার বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা তাদের দেশে নিয়ে যায়। আবার যদি মোট রেমিটেন্সের সাথে তুলনা করি তাহলেও একটা চিত্র পাওয়া যায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আমাদের মোট রেমিটেন্স আয় ছিল ১৪ হাজার ২২৮ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৪ হাজার ১০০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি শ্রমিক কর্মকর্তার ও বিশেষজ্ঞরা। তাহলে নীট রেমিটেন্স আয় দাঁড়ায় মাত্র ১০ হাজার ১২৮ মিলিয়ন ডলারে।

বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা কত, তারা কোথায় কোথায় কাজ করে? এর লেজে লেজে প্রশ্ন হবে যে সব কাজে এরা জড়িত বা নিয়োজিত সেসব কাজ কী বাংলাদেশের লোকেরা পারে না অথবা সেই দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী কী বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। কত বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করে তার কোনো সঠিক তথ্য আমি অন্তত কোনো খবরে দেখিনি। দুদিন পর পর এই সম্পর্কে নিরাপত্তামূলক খবর ছাপা হয়। বলা হয় বিপুল সংখ্যক বিদেশি আমাদের দেশে বিনাঅনুমতিতে কাজ করছে। অনেকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকিও বটে। এসব ঢালাও খবর ছাপা হয়। সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ইদানীং একটা কাগজে দেখলাম ‘বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট’ (বিওআই) থেকে অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন লোকের সংখ্যা মাত্র ২২ হাজার। উল্লেখ্য ‘বিওআই’ ছাড়াও আরো প্রতিষ্ঠান আছে যাদের অনুমতি নিয়ে বিদেশিরা কাজ করতে পারে। এর মধ্যে আছে ‘বিসিক’ এবং ‘বেপজা’। অতএব দেখা যাচ্ছে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ না থাকায় বিদেশিদের সঠিক সংখ্যা কত সে সম্বন্ধে কোন ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু মুখে মুখে অনেক গল্প আছে। ভাগ্যিস, রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকায় আমরা জানতে পারছি কত ডলার বিদেশিরা তাদের দেশে পাঠাচ্ছে। কিন্তু সেটা সরকারি হিসাব। সরকারি হিসাবে একজন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করে তার বেতনের ৭৫ শতাংশ দেশে পাঠাতে পারে। আরো পাঠাতে পারে তার সঞ্চয় ও অবসর ভাতা। বলা হয় সরকারি খাতে যে ডলার বিদেশে পাঠানো যায় ঠিক তত পরিমাণ ডলার বেসরকারি চ্যানেলে যায়। অবশ্য একমাত্র ‘উপরওয়ালা’ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না ঐ ‘হুন্ডি’ মারফত কত ডলার বিদেশে যায়। না যাক, একটা তথ্য অবশ্য পাওয়া সম্ভব—আর সেটা হচ্ছে বিদেশিরা কোন কোন খাতে কাজ করে। মোটামুটি একথা আমাদের সবারই জানা তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করছে পোশাক খাতে। পোশাক খাত মানে বস্ত্র খাতে। এ ছাড়া রয়েছে ওষুধ, খাদ্য উত্পাদন, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন ও ইউটিলিটি প্রডাক্ট খাত। বিভিন্ন সময়ে খবরের কাগজে প্রচালিত রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের দেশে যে সমস্ত দেশের লোকেরা কাজ করে তার মধ্যে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, কোরিয়া। এ ছাড়াও কিছু দেশের নাগরিক আছেন যারা কাজ করেন এখানে। খবরানুযায়ী তারা যে কাজ করেন সেগুলো দক্ষকর্মীদের কাজ। যেমন ক্রয়-বিক্রয়, হিসাবরক্ষণ, টেকনিক্যাল কাজ, আইটির কাজ, বায়িং হাউজের কাজ, মার্কেটিং ইত্যাদি। যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা আগেই উল্লেখ করেছি সেখানকার রিপোর্ট অনুযায়ী যে সব কারণে বিদেশিরা এখানে কাজ করতে আসে তার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে কয়েকটা কারণ। আমাদের কর্মীদের মৌখিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাদের পেশাগত দক্ষতা কম। এছাড়া স্বস্ব কাজেও তাদের দক্ষতা কম। এসবের অনুপস্থিতিতেই বিদেশিরা বাংলাদেশে আসে। অথচ বিপরীতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে কর্মপ্রার্থী লোকের কোনো অভাব নেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত শ্রমিক কর্মীর কোনো অভাব নেই। দেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। আমার হাতের কাছেই আছে, একটা নির্ভরযোগ্য তথ্য। ‘বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস’ (বিবিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালে দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ লোকদের সংখ্যা ছিল এক কোটি ৩২ লক্ষ। এর মধ্যে ১১ লক্ষ ৪০ হাজার তরুণ ছিল বেকার।

এদিকে বিশ্বব্যাংক ও ‘আইএলও’ এর তথ্যেও দেখা যাচ্ছে দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মোতাবেক ২০১০ সালে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা বেড়ে উন্নত হয়েছে ৯ দশমিক ২ শতাংশে। ‘আইএলও’ বলছে যে ২০টি দেশে প্রতিবছর বেকারত্ব বাড়ছে তার মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১২ তম। বলা বাহুল্য এই তরুণ বেকারদের মধ্যে শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত এই উভয় ধরনের বেকারই রয়েছে। এসব তথ্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আমরা এক বড় সমস্যায় নিপতিত হয়েছি। দেশে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারে ভর্তি, অথচ বিদেশিরা হাজারে হাজারে আসছে দক্ষতাসম্পন্ন কাজগুলো করতে। এবং এসব শ্রমিক-কর্মকর্তা-দক্ষকর্মী আমদানি করছে কে? সরকার, না সরকার নয়। করছে বেসরকারি খাত; তাও করছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারত থেকে- গরজ বড় বালাই!

দেখা যাচ্ছে সরকার এবার সজাগ হয়েছে। দক্ষতার ঘাটতি পূরণের জন্য একটা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বিশাল প্রকল্প- এক দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের। টাকার অঙ্কে এর মূল্য হয় ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই টাকায় ২৬ লক্ষ শ্রমিক এবং মধ্যস্তরের ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে এক মাস থেকে ছয় মাস। মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকার দেবে মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার। বাকি ডলার দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। খবরে বলা হয়েছে এই প্রকল্পের প্রথম স্তরের কাজ শেষ হয়েছে। প্রায় ২১০০ পোশাক কর্মীর প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণ দেবে ‘বিজিএমইএ’, ‘বিকেএমইএ’, বিটিএ সহ অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান। বলা যায় বিশাল কর্মযজ্ঞ। এর উপযোগিতা আছে সন্দেহ নেই। তবে কথা থাকে। বিদেশিদের টাকা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ হচ্ছে, যা সত্যি-সত্যি আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রশিক্ষণ হচ্ছে। নিজেদের তাগিদে হলে ফল পাওয়া যাবে- আর যদি ডলারের ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ হয় তাহলে ভিন্ন কথা। আমাদের অসুবিধা হচ্ছে আমাদের সমস্যা আমরা বুঝি না, বিদেশিরা বোঝায়। আর ডলার দিলে আমরা লাফ দিয়ে পড়ি। আশা করি এই প্রকল্পটির দক্ষ এমন হবে না।

পরিশেষে একটা কথা বলা দরকার। প্রশিক্ষণ আগে নয়। কথা তিনটি; শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা। শিক্ষা ঠিক না করে প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছুই লাভ হবে না। ঘরে ঘরে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। রয়েছে পাবলিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আমার মনে হয় এসবের সিলেবাস কর্মমুখী নয়। আমাদের ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্পের চাহিদার সাথে শিক্ষার পাঠ্যসূচির কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা বিএ পাস ছেলে মেয়ে যদি বাংলায় দুটো বাক্য শুদ্ধ করে লিখতে না পারে তাহলে তারা প্রশিক্ষণ কী নেবে? একটা ইংরেজি বই পড়ে যদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করতে পারে তাহলে প্রশিক্ষণের টাকা ব্যয় হবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। পাঠ্যসূচির দিকে নজর দিন আগে। বিখ্যাত বেসরকারি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়- বিবিএ, এমবিএতে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কাপড়ের দোকানের সমস্যা কী তা, বই সব ইংরেজিতে লেখা। ছেলে-মেয়েরা বোঝে না। তাদেরকে গেলানো হয়। কথা বাড়ালাম না। শিক্ষায় জোর দিন, প্রশিক্ষণ করুন। শক্ত ভিত তৈরি করুন- তার উপর একতলা করুন।

লেখক :ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়