১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স আজ চুয়ালি্লশ বছর। বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন যেন একটু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন এবং প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে বেশকিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে। নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি মাঝেমধ্যে তার লেখালেখিতে বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে এসব সামাজিক সূচক উল্লেখ করে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা বলে থাকেন। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি (১১৯০ ডলার), প্রায় দুই দশক ধরে কম-বেশি ৬ ভাগ হারে বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধি ধরে রাখা, শতকরা ৬০ ভাগ হারে দরিদ্র হ্রাস এবং চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর হার কমে আসা, একদিকে মোট প্রজনন হার (TFR) হ্রাস (১.৮%) পাওয়া অন্যদিকে মানুষের গড় আয়ু (প্রায় ৭০ বছর) বেড়ে যাওয়া, ১৯৭৩ সালের তুলনায় তিন গুণের বেশি খাদ্য উৎপাদন বেড়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত হওয়া, দেশের সার্বিক সঞ্চয় বিনিয়োগ অনুপাত বেড়ে যাওয়াসহ প্রভৃতি সূচকের দিকে তাকালে আমরা আমাদের দেশকে নিয়ে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অপেক্ষাকৃত এক উজ্জ্বল বাংলাদেশের ছবি দেখতে পাই।
বাংলাদেশ এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ধারণ করে এক ধরনের ‘উন্নয়ন ভিশন’ নিয়ে সামনে এগোচ্ছে। উন্নয়ন ভাবনা থেকে উচ্চারিত ২০২১ এবং ২০৪১ সালের রূপকল্প অর্জনের মধ্য দিয়ে এ দেশ তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে বলে অনেকের মধ্যে এক ধরনের আশাবাদ জন্মেছে এবং তার কিছু বাস্তবতাও সৃষ্টি হয়েছে। এ আশাবাদকে বাস্তব রূপ দিতে হলে সরকারকে এখন কিছু অবকাঠামোগত ভিত্তি তথা সুযোগ-সুবিধা তৈরি কিংবা বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। এসব উদ্যোগ হাতে নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের পক্ষে এখন আর কোনো কল্পনাবিলাসী বিষয় নয় কিংবা ঘুমিয়ে দেখা কোনো স্বপ্নও নয়। ভারতের প্রয়াত বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলতেন- স্বপ্ন সত্যি করার আগে স্বপ্ন দেখতে হয়। তার মতে- ‘ওটা স্বপ্ন নয়, যা তুমি ঘুমিয়ে দেখ; স্বপ্ন তা-ই, যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না’। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারকে তাই নির্ঘুম থেকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে দু-চারটি চ্যালেঞ্জ হাতেও নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি হচ্ছে- পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের উদ্যোগ। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকারের কমিটমেন্ট এবং এক্ষেত্রে সরকারের আগ্রহের ব্যাপারে এ দেশের মানুষ এখন আস্থাবান। এই সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার মানুষের চোখ-মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় সরকার কর্তৃক গৃহীত যথাযথ কোনো উন্নয়ন প্রকল্প মানুষকে কতটা স্বপ্ন দেখাতে পারে; কতটা আশাবাদী করে তুলতে পারে। পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ভারতের সীমান্তের সঙ্গে আমাদের স্থলবন্দরগুলো এবং বিশেষ করে মংলা সমুদ্রবন্দর এখন থেকেই যেন প্রাণ পেতে শুরু করেছে। সরকারের আরও কিছু মেগা প্রকল্প যেমন : কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ; ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ; রামপাল, রূপপুর প্রভৃতি স্থানে পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ, আমদানিকৃত তরল গ্যাসের জন্য এল এন জি গ্যাস টার্মিনাল নির্মাণ, সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক মানের একটি মেগা এয়ারপোর্ট নির্মাণ প্রভৃতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি বড় সমুদ্রবন্দর এবং মানসই একটি মেগা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ঘিরে সিঙ্গাপুর কীভাবে এগিয়ে গেছে এই উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। চীনকে বিবেচনায় নিলে চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি মানুষ এ অঞ্চলে বসবাস করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ চীনের অর্থনীতি এখন যথেষ্ট তেজি। অন্যদিকে আরেক বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ ভারতও অর্থনৈতিক এবং কৃৎকৌশলগত দিক থেকে আজ এক উদীয়মান শক্তি। বাংলাদেশ যদি পূর্বে উলি্লখিত মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুততার সঙ্গে কয়েক বছরের মধ্যে কোনোভাবে বাস্তবায়ন করে ফেলতে পারে তাহলে চীন এবং ভারতের সঙ্গে হাতে হাত ধরে অর্থনৈতিকভাবে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ এক বিশাল সম্ভাবনার দেশে পরিণত হতে পারে। এখন থেকে বেশ কয়েক বছর আগে ডেইলি স্টার পত্রিকার ১০ম বর্ষপূর্তি কিংবা যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে এ ব্যাপারে নোবেল জয়ী ড. মো. ইউনূসের একটি বক্তৃতা শুনেছিলাম। এ বক্তৃতা পরে দু-একটি পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। তার বক্তৃতায় ড. ইউনূস কীভাবে বাংলাদেশ এশিয়ার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতের সঙ্গে হাতে হাত রেখে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। আমাদের উন্নয়নবিদ এবং নীতি-নির্ধারকদের ড. ইউনূসের সেই বক্তৃতাটির ওপর সম্ভব হলে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে অনুরোধ করি। বর্তমান সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা আর নিরলস পরিশ্রমের কারণে বাংলাদেশের মানুষ আজ দিন দিন একটু আশাবাদী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নির্ঘুম যাত্রায় শুধু দেশের মানুষই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশও বেশ খানিকটা অবাক হচ্ছে। দেশ-বিদেশে তিনি তার কাজের স্বীকৃতিও পাচ্ছেন। সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক এসব স্বীকৃতি প্রধানমন্ত্রীর নির্ঘুম উন্নয়ন যাত্রার টেস্টিমনি বৈকি! পৃথিবীর বড় দেশগুলো যখন অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি এবং সামাজিক সূচকগুলো তখন সামনের দিকে। বিভিন্ন সামাজিক সূচক ছাড়াও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে ১৯৮০-এর দশকে আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির সিংহভাগ (প্রায় ৭০/৮০ শতাংশ) নির্ভরতা ছিল বিদেশি সাহায্যের ওপর, এখন সেই চিত্র ঠিক উল্টো। বাংলাদেশের বাজেটের আকার এখন অনেক বড়।
২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩০.২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ১ কোটির বেশি মানুষ আজ পৃথিবীর নানা দেশে অবস্থান করছেন। তারা সেসব দেশে আয়-রোজগারও করছেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগারে জমা ২৩ বিলিয়ন ডলার সমান রিজার্ভ, সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি (২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রায় ১৫৬৬.৭ বিলিয়ন টাকা), কৃষি শ্রমিকের আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি বাংলাদেশের মানুষকে একদিকে আশাবাদী করে তুলছে ঠিকই কিন্তু এ দেশের সামগ্রিক শাসনব্যবস্থার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্রও আমাদের কখনো কখনো ভাবিয়ে তোলে।
বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখনো অনেকটা অনুপস্থিত। দেশের শাসনব্যবস্থাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঘুষ-দুর্নীতি-টেন্ডারবাজি ইত্যাদি আজকাল অনেকটা দৃশ্যমান। সমাজ এবং রাষ্ট্রে মানবাধিকারের বিষয়গুলো কখনো কখনো প্রশ্নসাপেক্ষ। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ৫৯টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ‘রাজনীতিজীবীদের’ এক ধরনের দাপট এবং দৌরাত্দ্য কখনো কখনো দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিবেশ- পরিস্থিতিকে অশান্ত করে ফেলার বিষয়টি আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। একদিকে শিক্ষাক্ষেত্রের বিশাল অর্জন অন্যদিকে শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতা, রাস্তায় নকলের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের মিছিলের শব্দ গ্রহণযোগ্য নয়। রাজধানী কিংবা দেশের বড় শহরগুলোতে বসবাসকারী মানুষ তাদের দৈনন্দিন যাতায়াত ব্যবস্থা, গ্যাস, পানি, পরিবেশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে যেসব বিশৃঙ্খলা তা নিয়ে স্বস্তিতে নেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের বক্তব্য উল্লেখ করে সম্প্রতি দু-একটি পত্রিকা খবরের হেডলাইন করেছে- ‘ঢাকা এখন আইসিইউ-তে’। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে প্রায় সব জায়গায় যথাযথ নাগরিক সুবিধার অভাব, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এসবের কারণে সরকারের অর্জনগুলো কখনো কখনো যেন ক্লিশে হয়ে যেতে দেখা যায়। বিভিন্নভাবে ক্ষমতাবানরা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের কারও কারও এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার খবরে আমাদের মধ্যে এক ধরনের আশাভঙ্গের অবস্থা তৈরি হয়। আর তখনই সরকারের আশাজাগানিয়া প্রচেষ্টাগুলো আমাদের কাছে ধূসর এবং মলিন হয়ে যেতে বসে- উদ্ভব ঘটে এক আশাহত মননের। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সুযোগ সবসময় আসবে না। সম্মিলিতভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি ও প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশকে স্বপ্ন পূরণের জায়গায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এবং সময় এখনই।