বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ তার জনবল। জনগণের সাহায্যে সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতি অনেকদূর নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এর জন্য চাই দক্ষতা। দক্ষতার অভাবে জনবল প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অদক্ষ জনবলের উত্পাদনশীলতা কমে যায় যার জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তার অবদান হয় সীমিত।
দক্ষ জনবলের অভাবের বিষয়টি প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। সব মহল থেকেই বলা হচ্ছে দেশে জনসম্পদের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে দক্ষ লোক এনে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। খোদ অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে সব বিদেশি কাজ করে বেতন-ভাতা বাবদ তারা প্রতি বছর ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বছর ভিত্তিক হিসাবে দেখা গিয়েছে ২০১৩ -২০১৪ অর্থবছরে দেশের বাইরে চলে যাওয়া অর্থ ৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। টাকার হিসাবে এই সংখ্যা হলো ৩০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে কাজ করতে বেশ কিছু সংস্থা থেকে অনুমতি নিতে হয় যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। শুধু বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে কাজের অনুমোদন নেয়া বিদেশিদের সংখ্যা এখন প্রায় ২২ (বাইশ) হাজার। এদের বেশিরভাগই কাজ করতে আসে বস্ত্র ও পোশাক খাতে।
অদক্ষ জনবলের ক্ষতিকারক অন্য দিকও রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যেসব অভিবাসী শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে যায় দক্ষতার অভাবে তারা মূলত কম বেতনের চাকরি পায়। দক্ষতা থাকলে তাদের চাহিদা বৃদ্ধি পেত এবং বেশি বেতনের চাকরি পেত। দক্ষ জনসম্পদ থাকলে বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি সংখ্যায় শ্রমিক বিদেশে যেতে পারতো। দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশ দু’দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টির উপায় হচ্ছে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ। পাকিস্তান আমল থেকে কয়েকটি খাতে দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চালু ছিল। বুনিয়াদী শিক্ষার অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের কর্মসংস্থানের সুযোগও ছিল সীমিত। দেশে তো বটেই, বিদেশেও তাদের চাহিদা ছিল কম। ধীরে ধীরে এর পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ হবার পর বিদেশে গিয়ে অদক্ষ, স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের মতো বাঙালিদের বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট পাওয়ার সমস্যা ছিল না। দলে দলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেতে শুরু করে। এদের অধিকাংশই ছিল অদক্ষ অথবা স্বল্প দক্ষ। বিদেশে যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ পাবার সুযোগ তারা কমই পেয়েছে। তুলনামূলকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে এবং মালয়েশিয়ার মত দেশে অন্য দেশের শ্রমিকদের দক্ষতার মান ছিল বেশি যার জন্য তারা বেশি বেতনের চাকরি পেয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশের ভেতর বস্তু ও পোশাক খাতসহ অন্য খাতের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। এসব খাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা মেটানোর মত জনসম্পদ তৈরি হয়নি। এর ফলে স্বল্প দক্ষ শ্রমিক দিয়েই কাজ করতে হয়েছে যার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্পাদনশীলতা রয়ে গিয়েছে নিচের স্তরে। অনেক প্রতিষ্ঠান অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং কাজ করার মাধ্যমে হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জন করার কৌশল গ্রহণ করেছে। এতে তাদের উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অন্য দেশের তুলনায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছে। কিছু কিছু খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উদ্যোগে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প খাত অন্যতম। তবু চাহিদার তুলনায় দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে স্কুল এমনকি কলেজের পরীক্ষা পাস করা ছাত্র-ছাত্রীরা দক্ষতার অভাবে বেকার থাকতে বাধ্য হয়েছে। দক্ষতা থাকলে দেশের ভেতর এদের কর্মসংস্থান হওয়া ছাড়াও বিদেশে গিয়ে চাকরির সুযোগ থাকতো।
দেশের ভেতরে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট সংখ্যায় দক্ষ শ্রমিকের প্রশিক্ষণ দিতে পারছে না এবং অন্য দিকে দেশে ও বিদেশে কাজ করার জন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা হচ্ছে না, এই পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), সুইজারল্যান্ডের সাহায্য সংস্থা এবং আরো কয়েকটি দাতা সংস্থার সহযোগিতায় দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর আগে ২০১২ সালে সরকার জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করে। এই নীতিতে কাজের গতি ও পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি খাতের যৌথ অংশগ্রহণে এই নীতির অন্তর্গত কার্যক্রম বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথম পর্বে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে “দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশিক্ষণ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেন তারা অধিক সংখ্যায় উচ্চ মানে প্রশিক্ষণ দিতে পারে।
এডিবি ও অন্যান্য দাতা সংস্থার সহযোগিতায় যে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে তার নাম ‘কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতায় বিনিয়োগ’। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। এতে অংশগ্রহণ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনশক্তি রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়। এদের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান দক্ষতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয় তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি জানার জন্য একটি জরিপ করা হয়। এই জরিপের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি সাহায্যের প্রয়োজন নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক এবং কারিগরি সাহায্য প্রদান করে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মসূচি সম্প্রসারিত করা হবে। যে ৩২টি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সরকারি খাতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে ৪৭৪০০ দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্যে। এরা আগে থেকেই নিজেদের উদ্যোগে দক্ষতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। কিন্তু এই প্রশিক্ষণ ছিল শুধু নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্যে। প্রকল্পের অধীনে সে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তার উদ্দেশ্য ব্যাপক পরিধিতে দক্ষতা সৃষ্টি। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও বিদেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারি এবং সেবরকারি খাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ২৬০,০০০ হবে বলে হিসাব করা হয়েছে। এদের ৭০ ভাগের কর্মসংস্থান দেশেই হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রকল্পটি ২০১৪ থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত চলবে। এর জন্য মোট ব্যয় করা হবে ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এই অর্থের শতকরা ৩৩ ভাগ আসবে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক থেকে। বাংলাদেশ সরকারের খরচ হবে শতকরা ১৯ ভাগ। অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে আসবে শতকরা ৩৮ ভাগ। সময়ের মেয়াদে এবং টাকার অঙ্কে এত বড় প্রশিক্ষণ প্রকল্প এর আগে নেয়া হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি খাতে এত মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানও অন্য কোনো প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেনি। সমন্বয় সাধন একটি বড় সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ। যেসব অংশগ্রহণকারী সংস্থা দক্ষতা প্রশিক্ষণের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করছে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিও প্রয়োজন যার জন্য ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়।
অতীতে বাংলাদেশে অনেক প্রকল্প উন্নয়নের নামে হাতে নেয়া হয়েছে। তাদের বাস্তবায়ন সব ক্ষেত্রে সন্তোষজনক হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন যেন ফলপ্রসূ হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী প্রকল্প। এর সফল বাস্তবায়ন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে। এটি বেকারত্ব সমস্যার সমাধানে যেমন অবদান রাখবে, একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও সুগম করবে। বাংলাদেশের জন্য দুটিরই প্রয়োজন।