বাবার আশা জাহিদ একদিন নোবেল পাবে

ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি দুর্বলতা ছিল। পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। তবে সেই ইচ্ছাকে পাশ কাটিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু কৃতিত্বটা মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কপালে ছিল না। সুযোগ পেয়ে চলে যান ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিনে। পদার্থ বিজ্ঞানের একের পর এক ডিগ্রি যোগ হতে থাকে তার ক্যারিয়ারে। পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে একজন সফল গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। তিনি বাংলাদেশের গর্ব প্রফেসর ড. এম জাহিদ হাসান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। দীর্ঘ ৮৫ বছরের গবেষণায় যে সফলতা আসেনি, তা করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এ পদার্থ বিজ্ঞানী। ভাইল ফার্মিয়নের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের জগতে আলোচনার ঝড় তুলেছেন। অনন্য এ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হতে পারেন তিনি। শুক্রবার টেলিফোনে মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. জাহিদ বলেন, এটি একটি এক্সাইটিং এবং ইন্টারেস্টিং কাজ ছিল। এ ধরনের একটি আবিষ্কার করতে পেরে খুবই ভাল লাগছে। এটি সম্পূর্ণরূপে পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন একটি ধারণা। ভাইল কণাটি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ কণাটি অদ্ভুত। এর মাধ্যমে শুধু পদার্থ বিজ্ঞান নয়, জীববিজ্ঞান ও রসায়নের ব্যাপক উন্নতি সাধন হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে কি চিন্তা করেন জানতে চাইলে ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে এখানকার তরুণ প্রজন্ম যথেষ্ট স্মার্ট। তারা প্রচণ্ড মেধাবী, উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়। কিন্তু কি কারণে তারা পিছিয়ে পড়ছে তা বোধগম্য নয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সবকিছুতে রাজনীতির একটা প্রভাব আছে। তবে আমি কোন রাজনৈতিক দল বা সরকারের সমালোচনা করছি না। আমি একটা জাতি হিসেবে সবাইকে চিন্তা করতে বলি। এই জাতির অনেক সম্ভবনা আছে। বাংলাদেশের তরুণদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে, প্রশিক্ষণ দিলে, তাদের সুবিধা দিলে তারা কেন পারবে না। এটা সম্ভব হলে একজন নয়, শত শত হাজার হাজার বিজ্ঞানী তৈরি সম্ভব। তিনি জানান, ভাইল ফার্মিয়নের অস্তিত্ব আবিষ্কারের ফলে কেবল তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানই পাল্টে যাবে না, বৈপ্লবিক পরিবর্তনও ঘটবে ইলেক্ট্রনিক ও কম্পিউটারের বাস্তব জগতে। সন্তানের সাফল্যে গাজীপুর-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট রহমত আলী উচ্ছ্বসিত। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। মানুষের সেবা করবে। কিন্তু তার ইচ্ছার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছেন। জাহিদ শুধু বাংলাদেশের নয়। তিনি এখন সারা বিশ্বের গর্ব। ধানমন্ডির বাড়িতে কথা হয় গাজীপুর-৩ আসনের এমপি প্রবীণ আইনজীবী রহমত আলীর সঙ্গে। নোবেল প্রাপ্তির মাধ্যমে ছেলের এই সফলতা যেন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে সেই অপেক্ষায় আছেন তিনি। বলেন, জাহিদের প্রতিভা আল্লাহ প্রদত্ত। তাই আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ করেন। শিশু জাহিদকে কোলে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আশীর্বাদ করেছিলেন, এই ছেলে একদিন অনেক বড় মানুষ হবে। বিশাল মনের মানুষ হবে। বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ওইদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। অ্যাডভোকেট রহমত আলী মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর সেই কথা আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জাহিদকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসও একই কথা বলেছিলেন বলে জানান এমপি রহমত আলী।
ইলেকট্রনিক আর কম্পিউটারের জগতটা এমনিতেই বদলে যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত উন্নতি হচ্ছে এক্ষেত্রে, কিন্তু জাহিদ হাসানের আবিষ্কার এটাকে যে গতি দেবে, মসৃণতা দেবে তা কল্পনাতীত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের একদল গবেষক পদার্থবিদ জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে পরীক্ষাগারে খুঁজে পান অধরা ভাইল ফার্মিয়ন। এ আবিষ্কার এখনকার মুঠোফোন, কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর গতি বাড়াবে, হবে শক্তি সাশ্রয়ী। বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে ভাইল ফার্মিয়নের পরীক্ষামূলক প্রমাণের বিষয়টি বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। ১৯২৯ সালে হারম্যান ভাইল এ কণার অস্তিত্বের কথা প্রথম জানিয়েছিলেন। আরেক জাতের কণা হলো ‘বোসন’, যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাঙালি পদার্থ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তার আবিষ্কারের ৯১ বছর পর ভাইল ফার্মিয়নের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত হতে যাচ্ছেন আরেক বাঙালি জাহিদ হাসান।
ড. এম জাহিদ হাসানের জন্ম ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডে ১৯৭০ সালের ২২শে মে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় জাহিদ। ছোটবেলা থেকেই পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি অন্য রকম আকর্ষণ ছিল ড. জাহিদের। স্কুলে পড়া অবস্থায় একটি সায়েন্স ফিকশনের বই লিখেছিলেন। ‘এসো ধূমকেতুর রাজ্যে’ নামক বইটি প্রকাশ হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৮৬ সালে ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন জাহিদ হাসান। ১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। এরপর চলে যান আমেরিকায়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনভার্গের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ নিতে অধ্যয়ন করেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিনে। বিষয় হিসাবে বেছে নেন প্রিয় বিষয় পদার্থ বিজ্ঞান। অস্টিনে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষে চলে যান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করতে। পদার্থ বিজ্ঞানে পিএইচডি চলাকালেই তার নাম ডাক পদার্থ বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কাজ করেন বহু নামী দামি নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে এবং একপর্যায়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার অফার পান। পিএইচডি শেষ করেই আইনস্টাইন, নিলস বোর, ওপেন হাইমারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটনে যোগ দেন ২০০২ সালে। এরই মধ্যে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী তার তত্ত্বাবাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। প্রকাশ করেছেন ১০০ এর বেশি জার্নাল পেপার, যার ১৬,০০০ এর মতন সাইটেশান হয়ে গেছে। এসব পেপারের প্রায় সবগুলোই ছাপা হয়েছে নেচার, সায়েন্স, ফিজিক্যাল রিভিউ, ফিজিক্স টুডের মতো বিখ্যাত সব সায়েন্স জার্নালে। ১৯৯৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ২২৫ এর অধিক কনফারেন্স ও সেমিনারে লেকচার দিয়েছেন। কাজ করছেন সিইআরএন ল্যাব, ব্রকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাব, লরেন্স বার্কলে ল্যাবের মতো বিখ্যাত সব ল্যাবরেটরিতে। ইতালি, সুইডেন, ভারত, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক লেকচার দিচ্ছেন। যুক্ত আছেন সৌদি আরবের কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও। বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটিতেও তিনি আছেন। স্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার সারাহ আহমেদ মাইক্রোসফট করপোরেশনের বড় কর্মকর্তা। ছেলে আরিক ইব্রাহিম ও মেয়ে সারিনা মরিয়মকে নিয়ে তাদের সংসার। ব্যক্তিগত জীবনে রাজনীতিবিমুখ ড. জাহিদ। তবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তিনি।

এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত