পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, তো আবার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা- হঠাৎ হঠাৎ তৈরি হওয়া এমন নানা বিব্রতকর অবস্থার কারণে গত পাঁচ বছর উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বসার সর্বোচ্চ মঞ্চ বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) সম্মেলন ডাকতে পারেনি সরকার। যে কারণে পাঁচ বছর মেয়াদি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড উন্নয়ন সহযোগীদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ হয়নি সরকারের। যার ফলে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত সহযোগিতাও মেলেনি। গত পাঁচ বছরে কয়েক দফায় সম্মেলনের জন্য তারিখ ঠিক করা হলেও পরে তা অনিবার্য কারণ দেখিয়ে স্থগিত করা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। এসব কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব দেখা দেয়। অবশ্য দেশে এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই। প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের হুমকি নেই। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের বেশ উন্নতি হয়েছে। ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে জাতিসংঘের চলমান ৭০তম অধিবেশনে। তাই আসছে নভেম্বরেই উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠকে বসার মোক্ষম সময় মনে করছে সরকার। সে জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১৫ ও ১৬ নভেম্বর দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যাতে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকার সম্মতি দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার নীতিনির্ধারকরাও সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বেশ কয়েকটি কারণে এবারের বিডিএফ সম্মেলনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তাঁরা বলছেন, ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি বাস্তবায়নের পথচলা শুরু হবে আগামী বছর থেকে। এসডিজিতে অন্য অনেক সূচকের সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অংশীদারত্বকে আরো কার্যকর ও জোরালো করা। তাই নতুন কৌশলপত্র বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের বিকল্প নেই। পাশাপাশি এসডিজি বাস্তবায়নে প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন। সে জন্য বিডিএফ সম্মেলন জরুরি। এ ছাড়া সরকার আগামী বছর থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করতে যাচ্ছে, যেটা উন্নয়ন সহযোগীদের জানানো অত্যন্ত জরুরি। কারণ এ আলোকেই উন্নয়ন সহযোগীরা আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের বিডিএফ সম্মেলনে ছয়টি বিষয় গুরুত্ব পাবে। ছয়টি অধিবেশনে ছয় বিষয়ে আলোচনা হবে। প্রথম অধিবেশনে আলোচনা হবে বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে যাওয়ার সংগ্রাম ও ইতিহাস। এর সঙ্গে থাকবে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পেঁৗছানোর জন্য প্রণীত বিভিন্ন কৌশলপত্র। একই সঙ্গে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির হালচিত্র নিয়েও আলোচনা থাকবে প্রথম অধিবেশনে। দ্বিতীয় অধিবেশনে থাকবে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ ও কর্মকৌশল। সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য- এমন প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গুণগত শিক্ষা ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য নিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা থাকবে পরের অধিবেশনে। সুশাসন এবং উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে এবারের বিডিএফ সম্মেলনে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে থাকবে আলাদা একটি অধিবেশন। যেখানে সম্প্রতি অনুমোদনপ্রাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র নিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের মতামত চাওয়া হবে। অবশ্য ২০১০ সালের বিডিএফ বৈঠকের কিছু বিষয় আবারও এবারের সম্মেলনে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা, অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থাকে শক্তিশালীকরণ, দুর্নীতি কমানো, গণতন্ত্রের বিকাশসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে এবারের বিডিএফ সম্মেলনে।
জানতে চাইলে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মনোয়ার আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৫ ও ১৬ নভেম্বরের বিডিএফ সম্মেলনকে ঘিরে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্মেলনে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিল উন্নয়ন সহযোগীদের সামনে তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সভায় যোগদানের আগে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, আগামী মাসেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি অনুমোদন দেওয়া হবে।
এদিকে এবারের বিডিএফ সম্মেলনকে সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে ইআরডির সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনকে সভাপতি করে ২৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিবদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
একসময়ের ‘প্যারিস কনসোর্টিয়াম’ রূপান্তরিত হয়ে ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম (বিডিএফ) নামে পরিচিত হয়। ২০০২ সালে সর্বপ্রথম ঢাকায় বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সরকারের বৈঠকে অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারা অংশ নিতেন, যা ‘প্যারিস কনসোর্টিয়াম’ নামে পরিচিত ছিল। ঢাকায় এ সম্মেলন হবে সপ্তম। এর আগে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকাতেই সর্বশেষ বিডিএফ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছরে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে অবকাঠামো উন্নয়নে। সে জন্য অধিবেশনের বড় একটি অংশজুড়ে থাকবে অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন কৌশল প্রণয়ন ও আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলার অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।