ওদের স্বপ্ন যে অনেক বড়

অজয় দাশগুপ্ত

মকালে ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট একটি উপসম্পাদকীয় কলামের শিরোনাম দিয়েছিলাম এভাবে :’বেগম রোকেয়া যদি জান্নাত-সুমাইয়াকে এভাবে দেখতেন!’। সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার রামগাতী গ্রামের মলি্লকা সানাউল্লাহ আনসারী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীর দুই ছাত্রী জান্নাত-ই-খাতুন ও সুমাইয়া খাতুন কলাগাছের ভেলায় স্কুলে যাতায়াত করছে_ এমন ঘটনা নিয়ে উপসম্পাদকীয়টি লেখা। বন্যায় যমুনার চর এলাকায় অবস্থিত স্কুলটির যাতায়াত পথ তলিয়ে গেছে। এ কারণে হাঁটার বিকল্প ভেলা বেছে নিতে হয়েছে জান্নাত ও সুমাইয়ার মতো আরও অনেককে। যত বাধাই আসুক, স্কুল তো কামাই করা যাবে না! সবার ওপর তো পড়াশোনা, কী বলেন? সমকালের সিরাজগঞ্জের প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম খান রানার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিল। তার বাবা পেশায় রিকশাচালক। মেয়ের স্কুলে যাতায়াতে যাতে সমস্যা না হয়, সেজন্য তিনি ভেলাটি বানিয়ে দিয়েছেন। জান্নাতের পাশের বাড়ির মরিয়ম এবং হাসিও একইভাবে স্কুলে যায়।
২০ সেপ্টেম্বর (২০১৫) প্রথম আলো পত্রিকায় ‘বৈঠা বেয়ে স্কুলে’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয় _ নিজেরাই নৌকা বেয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার কাজী সুলতান আহম্মেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। তাদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার। মাঝখানে নদী। বর্ষাকালে প্রায় দেড় কিলোমিটার পানিপথ পেরিয়ে বিদ্যালয়ে পেঁৗছানোর জন্য হাঁটতে হয় আরও এক কিলোমিটার। শুকনো মৌসুমেও পেরোতে হয় নদী। তারা নিজেরাই লগি-বৈঠায় নৌকা চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসে।
পড়াশোনার প্রতি অদম্য আগ্রহই লগি-বৈঠা বেয়ে থইথই পানি পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রেরণা। ওদের স্বপ্ন যে অনেক বড়। এগোতে চায় অনেক দূর। প্রথম আলোর প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অসাধারণ এক ঘটনা। এই অদম্য-সাহসী মেয়েরাই চারপাশের অবরোধ ভাঙবে। সম্মিলিতভাবে তারা প্রতিকূলতা জয় করছে। আসুন, সবাই ওদের নৌকার যাত্রী হই। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এ ঘটনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। বেগম রোকেয়া এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন। মেয়েদের এগিয়ে চলার পথে চারদিকে কত প্রতিকূলতা। সেসব জয় করেই ওরা পড়ছে। আমাদের সমাজে শিক্ষার জন্য চাহিদা তৈরি হয়েছে। সবাই পড়তে চাইছে। এখন প্রয়োজন মানের প্রতি নজর দেওয়া।
‘বেগম রোকেয়া যদি জান্নাত-সুমাইয়াকে এভাবে দেখতেন!’ উপসম্পাদকীয়তে লিখেলিাম_ বেগম রোকেয়া যদি এমন দৃশ্য দেখতেন, নিশ্চিতভাবেই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতেন। ১৯০৯ সালে তিনি বিহারের ভাগলপুরে মেয়েদের পড়াশোনার জন্য চালু করেছিলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল। তখন তার বয়স মাত্র ২৯ বছর। রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সদ্য বিধবা মেয়েটি এ প্রেরণা কোথায় পেয়েছিলেন? তার নিজের শিক্ষা গ্রহণ সহজ ছিল না। বাধা এসেছিল পরিবার ও সমাজ থেকে। তিনি যেখানে বসবাস করতেন, সেখানকার বেশিরভাগ পরিবার উর্দুভাষী। অথচ তিনি শিক্ষা দিতে চান মাতৃভাষা বাংলায়। এ কারণে দুই বছর পর ১৯১১ সালে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয় কলকাতায়, একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে যা সগৌরবে চলছে।
বেগম রোকেয়ার মৃত্যু হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। বয়স মাত্র ৫২ বছর। নারীশিক্ষার বিস্তারে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে চলেছিল সাহিত্য সাধনা। নারীদের আত্মবিশ্বাসে ভরপুর করে তোলার উদাত্ত আহ্বান ছিল তার প্রায় সব লেখায়। তবে সবাই যে তাতে অনুপ্রাণিত হতো, সেটা বলা যাবে না। তিনি পদে পদে বাধাবিঘ্ন সহ্য করে এগিয়েছেন। তিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লিখেছিলেন। কিন্তু তা পূরণ মোটেই সহজ ছিল না। তার পথে ফুল নয়, সমাজই বিছিয়ে রেখেছিল কাঁটা।
চাঁদপুরের মতলব এলাকার লগি-বৈঠা বেয়ে স্কুলে যাওয়া ছাত্রীদের কারও বাবা মাছ বেচেন, কারও বাবা দিনমজুর। ছোটকাল থেকেই সংগ্রাম করে এরা বেড়ে উঠছে। খেয়ে না-খেয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কে তাদের হারাবে?
এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছে প্রায় ১২ লাখ ৮৩ হাজার ছাত্রছাত্রী। এদের মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ১৭ হাজার ছাত্রী। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছে প্রায় ৭ লাখ ৩৯ হাজার। এদের মধ্যে সাড়ে তিন লাখের বেশি ছাত্রী।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে ৪৪ বছর। এ সময়ের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে আমরা এগিয়েছি। বিশেষ করে অগ্রগতি শিক্ষায়। মাত্র ২৫ বছর আগের চিত্র দেখা যাক। ১৯৯০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় যত ছাত্রছাত্রী পাস করেছিল তাদের তিন ভাগের এক ভাগের মতো ছিল ছাত্রী। সব বোর্ড মিলিয়ে পাস করেছিল_ মাত্র ৪৪ হাজার ১২ জন। ২০১৫ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছে প্রায় ছয় লাখ ১৭ হাজার ছাত্রী। ১৯৯০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছিল ৮৭ হাজার ৪১৯ জন, তাদের মধ্যে ছাত্রী ২৪ হাজার ২৮৫ জন। অথচ ২০১৪ সালে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রীসংখ্যা ৩ লাখ ৪৬ হাজার। চলতি বছরে পাস করে আরও কিছু বেশি ছাত্রী। মাত্র ২৫ বছরে কী পরিবর্তন! বাংলাদেশের কেন ভালোর পথে পরিবর্তন ঘটবে না? জান্নাত-সুমাইয়ারা স্কুল-কলেজে যায় এবং একটি পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করতে পারে বলেই না এমন সাফল্য। এখন বস্তিবাসীর সন্তান পড়াশোনা করছে। পোশাকশিল্পের নারীকর্মীর সন্তানরা পড়ছে। গৃহভৃত্যের (যাদের আমরা ‘চাকর’ বলে উপহাস করি) সন্তানরা পড়ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সংবাদপত্রে ‘অদম্য মেধাবী’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ এখন রেওয়াজ। এতে দেখা যায়, হতদরিদ্র বা দিনমজুরের সন্তানরা কেবল টেনেটুনে পাস করছে না_ নিজের, পরিবারের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুখ উজ্জ্বল করছে। জিপিএ ৫ পাচ্ছে।
এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচটি শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রী প্রায় দুই কোটি। এর বাইরেও রয়েছে ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসায় পড়া ছাত্রছাত্রী। তারা যখন মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেবে, তখন আমরা আরও বেশি এসএসসি পাস করা ছাত্রী পেয়ে যাব। গত বছরের ডিসেম্বরে অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। এতে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ ছাত্রছাত্রী পাস করেছে। উত্তীর্ণদের মধ্যে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় সমান। এই ব্যাচের ছাত্রীরা দুই বছর পর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। আমরা আশা করব, তারা সবাই যেন নবম শ্রেণী ও দশম শ্রেণীর পড়াশোনা শেষ করে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে এবং শতভাগ পাস করে, সেজন্য বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলী ও কর্তৃপক্ষ এবং সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তাদের ঝরে পড়তে দেওয়া যাবে না। এখন নারীশিক্ষার যেভাবে প্রসার ঘটছে তাতে তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এক বছরেই ১০ লাখের বেশি ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করবে_ এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমরা এর সঙ্গে একটি তথ্যও মেলাতে পারি_ বিশ্বে অন্তত ৭৮টি দেশ রয়েছে, যেখানে মোট লোকসংখ্যা ১০ লাখের কম।
আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এটা পরিবর্তনের জন্য নিরন্তর চেষ্টা চাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের বড়ই অভাব_ এ নিয়ে খেদোক্তি কম নেই। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতায় আসছে না_ এটাই বাস্তব। বেতন কাঠামো এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। শিক্ষকরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিএ-এমএ পাস করার পর শিক্ষকতার বিষয়ে ট্রেনিং নিয়ে ১০-১৫ বছর চাকরির পর যে বেতন মেলে তা সরকারি অফিসের কেরানিদের চেয়ে বেশি হয় না। সঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে আকর্ষণবোধ করে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যাজেনমেন্টও বড় বাধা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব এ কমিটি দখল করায় মরিয়া হয়ে থাকে। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার স্কুল-কলেজকে ‘ব্যক্তিগত’ সম্পদ মনে করেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজে শিক্ষক নিয়োগ থেকে এখন লাখ লাখ টাকা আয় হয়। পিয়ন-দারোয়ান নিয়োগের সুপারিশও যায় এমপি সাহেবের কাছ থেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ সুপারিশ ‘খালি হাতে’ হয় না। স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণের দায়িত্ব এখন সরকার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। তারা এজন্য বরাদ্দ দেয়। ম্যানেজমেন্টে থাকা অনেকের জন্য এটাও এক উপার্জনের সুযোগ। তাদের আরও সুযোগ আছে_ সরকার অনেক প্রতিষ্ঠানের বেঞ্চ-চেয়ার-টেবিল বানাতে বরাদ্দ দেয়, লাইব্রেরিতে বই দেয়, বিজ্ঞান গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যালস দেয়। সবকিছুর কেনাকাটাতেই যে ভাগ বসানোর সুযোগ থাকে! দুর্ভাগ্য, এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করায় আগ্রহী ‘নেতার’ সংখ্যা যে হাতেগোনা! শিক্ষার মান বাড়ানোর প্রবল তাগিদ রয়েছে। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের আমূল পরিবর্তন ছাড়া সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। প্রথম আলোর ছবি ও প্রতিবেদন নিয়ে কথা হয় বিশিষ্ট কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছবিটি স্পষ্ট বার্তা দেয়_ কোনো প্রতিকূলতাই মেয়েদের দমাতে পারবে না। তাদের পড়াশোনার অদম্য স্পৃহার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। কেবল চাঁদপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে নয়, দেশের সর্বত্রই এমন চিত্র মিলবে। এখন রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে, তাদের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা, যাতে তারা দেশের যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারে, নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে এবং পরিবারের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাতে পারে। কেবল শিক্ষালাভ নয়, অর্জিত শিক্ষা যেন দেশ ও দশের কাজে লাগাতে পারে_ সেটাও নিশ্চিত করা চাই।