সম্ভাবনাময় কেরানীগঞ্জের তৈরি পোশাকশিল্প

* মেটাচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৮০ শতাংশ * প্রায় ১২ হাজার কারখানায় * ১৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত * সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চান ব্যবসায়ীরা

দেশের নামিদামি পোশাক কারখানাগুলোর তৈরি পোশাক ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশের বাজারে এসব ব্র্যান্ডেড পোশাকের চাহিদা থাকলেও দাম বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই এগুলো কেনা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে দেশের তৈরি পোশাকের চাহিদার ৮০ শতাংশ মিটিয়ে থাকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা অসংখ্য তৈরি পোশাক কারখানা। শ্রমিক অসন্তোষহীন সম্ভাবনাময় এ শিল্প ভবিষ্যতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশি মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম বলে মনে করেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। তবে এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক বলে জানান তারা।
সদরঘাট থেকে নৌকায় কিংবা বাবুবাজার ব্রিজ পার হয়ে হাতের বাঁয়ে গেলেই মিলবে কালীগঞ্জের পোশাকপল্লি। আগানগরের এই অঞ্চলে প্রায় ২ শতাধিক তৈরি পোশাকের মার্কেট গড়ে উঠেছে। এসব মার্কেটের তৃতীয়তলায় রয়েছে অসংখ্য পোশাক কারখানা। এছাড়া ছোট-ছোট অনেক টিনের ঘরেও চলছে পোশাক তৈরি। সব মিলিয়ে কেরানীগঞ্জে প্রায় ১২ হাজার পোশাক কারখানা রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। সরেজমিন দেখা যায়, ছোট ছোট টিনের ঘর থেকে বহুতল ভবনÑ সর্বত্রই ঘুরছে সেলাই মেশিনের চাকা, তৈরি হচ্ছে দামি-কমদামি নানা পোশাক। এসব পোশাকই ঢাকা হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেশের আনাচেকানাচে। এখানে জিন্সের প্যান্ট, শার্ট, টিশার্ট, গেঞ্জি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের পোশাক, আন্ডার গার্মেন্টসহ নানা ধরনের পোশাক তৈরি হয়। প্রতিটি পোশাকেই কমবেশি হালফ্যাশনের ছাপ স্পষ্ট। এখানকার পোশাক কারখানাগুলো শুধু দেশের মানুষের চাহিদাই মেটাচ্ছে না, একই সঙ্গে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিকের। অভ্যন্তরীণ বাজারে বছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করছে এখানকার কারখানাগুলো।
কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলেন, সুলভ মূল্যে মানসম্পন্ন পোশাক কেনার জন্য সারাদেশের ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। তাই বছরজুড়েই কেরানীগঞ্জের তৈরি পোশাকের চাহিদা থাকে। তবে ঈদ, শীত মৌসুমসহ বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ফরিদপুরের তিতুমীর বাজার থেকে আসা তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কেরানীগঞ্জ থেকে পোশাক কিনে এলাকায় নিয়ে বিক্রি করি। কারণ এখানে স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক পাওয়া যায়।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের দেওয়া তথ্যমতে, এখানে জিন্স প্যান্টের বিক্রয়কেন্দ্র আছে সাড়ে ৬ হাজারের মতো। এসব দোকানে প্যান্টের জোগান দেয় প্রায় ৩ হাজার কারখানা। পোশাক তৈরি-সংশ্লিষ্ট কারখানা আছে আরও ৪ হাজারের মতো। আছে ১৯০-২০০টি মার্কেট। সারাদেশ থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার পাইকার এখান থেকে পোশাক কেনেন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৬৫ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে সারা বছরে পোশাক বিক্রি হয় ২৩ হাজার ৭২৫ কোটি টাকার।
কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, নিরলস কাজ করে চলেছেন পোশাক শ্রমিকরা। সবচেয়ে বড় কথা এখানে কোনো শ্রমিক অসন্তোষ নেই। সময়মতোই বেতন-বোনাস-ওভারটাইম পান বলে জানান কারখানায় কর্মরতরা। একটি কারখানার শ্রমিক নাজমুল বলেন, মালিকরা কাজের বিনিময়ে টাকা দেন। তাই কোনো ধরনের ঝামেলা নেই। তবে এসব কারখানায় নারীদের কাজের ক্ষেত্র অনেক কম বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে আলম শপিং প্লাজার সুমাইয়া গার্মেন্টসের ম্যানেজার নূর হোসেন বলেন, এখানকার শ্রমিকরা পিস হিসেবে কাজ করেন। তাই হয়তো নারী শ্রমিকরা এখানে কাজ করতে কম আগ্রহী। পোশাকশ্রমিক আজাদ বলেন, এখানে আমরা মালিক-শ্রমিক মিলেমিশে কাজ করি। এমন অনেক মালিক রয়েছেন, যারা শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে এখন সফল ব্যবসায়ী। এজন্য তারা শ্রমিকের কষ্ট বোঝেন।
কেরানীগঞ্জের উদাহরণ টেনে তৈরি পোশাকশিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখান থেকে বিজিএমইএ কিংবা রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তারা শিা নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মেসার্স ইস্টার্ন গার্মেন্টসের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানকার পোশাকশিল্পে কারিগরদের কাজের ওপর বেতন দেওয়া হয়। প্রতি প্যান্ট বা শার্ট তৈরি ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত রেট নির্ধারণ করা আছে। সে হিসাবে একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়া মালিকরা নিজেদের স্বার্থে দ কারিগরদের অগ্রিম টাকা দিয়েও কাজ করিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, শোরুম ম্যানেজার, হিসাবরক বা অন্যান্য পদে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়ে থাকে।
সরকারি সহায়তা ও সঠিক নিয়ম-কানুনের মধ্যে এলে এখানকার ব্যবসায়ীরা দেশের রপ্তানি আয়েও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন বলে মনে করেন স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ। তিনি বলেন, এখানে ছোট পরিসরে থেকে ব্যবসায়ীরা অভ্যন্তরীণ তৈরি পোশাকের ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছেন। তারা সরকারি সহযোগিতা পেলে ও কারখানাগুলোকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে এলে এসব পোশাক শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে এ এলাকার পোশাকশিল্প।