শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ একটি ‘ব্রান্ড নেম’

লেখক :অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

গত ১৪ সেপ্টেম্বর (২০১৫) জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ঢাকায় সফররত জাতিসংঘ কর্মকর্তা আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অতুল খারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ এখন একটি ‘ব্রান্ড নেম’।’ তিনি শান্তিরক্ষীদের জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেইনিংয়ে ট্রেনিং কর্মসূচির প্রশংসা করে বলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে দু’টি টিম পাঠাবে। এর মধ্যে একটি টিম আসবে জাতিসংঘের সঙ্গে ব্যবসা অনুসন্ধান এবং অপর দলটি আসবে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বেসামরিক লোকদের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণের উপায় খুঁজে বের করতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব শান্তি রক্ষায় তাঁর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে তাঁকে বলেছেন, বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা শুধুমাত্র শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করছে না, সংশ্লিষ্ট দেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে।

গত বছর (২০১৪) ২৪ জুলাই হার্ভে ল্যাডসাউ-এর সাক্ষাতের সময় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় সৈন্য সরবরাহকারী রাষ্ট্র। এজন্য এই পদক্ষেপ নেয়া হলে শান্তিরক্ষা মিশনে মাঠ পর্যায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয় নিবিড় হবে। তাছাড়া জাতিসংঘ মিশন থেকে ফেরা বাংলাদেশি কর্মকর্তারাও মাঠ পর্যায়ের চাহিদাগুলোর বিষয়ে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ শান্তিরক্ষী সততা, শৃঙ্খলা ও সাহস নিয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়া সৈন্যদের প্রশিক্ষণে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস সাপোর্ট ট্রেইনিং’ (বিপসট) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গোত্রে গোত্রে সংঘাত নিরসন, যুদ্ধাঞ্চলে মানবিক সাহায্য সামগ্রীর কনভয় এবং জাতিসংঘ শরণার্থী শিবিরে আক্রান্তদের উদ্ধারে শান্তিরক্ষা বাহিনী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এসব কর্মযজ্ঞে নিবেদিত প্রাণ কর্মী। এদেশ থেকে আরো বেশি সৈন্য প্রেরণে ২০১৩ সালে জাতিসংঘে প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছে। কারণ শান্তিরক্ষায় পৃথিবীর সর্বত্রই তাদের বিচরণ সমুন্নত রয়েছে এখনো। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পৃথিবীর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্যোগময় পরিবেশে শান্তি স্থাপন করে অপরিচিত দেশের অচেনা মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং সপ্তম অধ্যায়ে শান্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সংঘর্ষে লিপ্ত দু’পক্ষের সম্মতি এবং মতৈক্যের উপর ভিত্তি করে শুরু হয়। শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ কর্তৃক অনুমোদিত একটি শান্তি চুক্তি বা শান্তি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে ১,১৮,৯৮৫ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছে। শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সদস্য সংখ্যা ৮,৯৩৬ জন যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে এদেশের সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের পতাকাতলে একত্রিত হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবাদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা/রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নাম। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর মোট ৯৬ জন সদস্য শহীদ হয়েছেন; পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন ১৪ জন। অন্যদিকে ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আয় হয়েছে ১১ হাজার ৪৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। স্মরণীয়, মহাজোট সরকারের আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৩ সালে ছিল ১৬.৩ বিলিয়ন ডলার। শান্তি মিশন থেকে আয় এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কারণ বিশ্বে সকল প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এ শান্তিরক্ষীদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে।

শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে-‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।’ বিশ্বের বিরোধপূর্ণ স্থানে জাতিসংঘের ডাকে শান্তি স্থাপন করা এজন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জরুরি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। জাতিসংঘকে শান্তি স্থাপনে সহায়তা দেয়া এবং পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হচ্ছে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচিত্র রকম আবহাওয়ায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় তাদের পদচারণা। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহনীয় গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সাথে মানিয়ে নিয়ে রাত-দিনের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে চলেছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। বিশ্ব মানবতা প্রতিষ্ঠায় আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর রয়েছে অসামান্য অবদান। কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী রয়েছে; রয়েছে বিচিত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ। এসব সামাজিক ভেদাভেদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে সকলকে নিয়ে সহাবস্থান নিশ্চিত করছে শান্তিরক্ষীরা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় দুশ’ আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন নিয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী দুটি যুদ্ধ জাহাজ ওসমান ও মধুমতি লেবানন এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সর্বদা টহলের কাজে মোতায়েন রয়েছে। মিশন এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলোতেও তাদের সতর্ক প্রহরা দেখা যায়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বিআর-১৩০ এয়ারক্রাফট, এমআই-১৭ ও বেল হেলিকপ্টারের মাধ্যমে কঙ্গো ও আইভরিকোস্টে জরুরি সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন, উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ তত্পরতায় দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ পুলিশের অনেক সদস্য মিশন এলাকার স্থানীয় প্রশাসনকে দাঙ্গা দমনে সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বের বিশৃঙ্খল এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে শান্তি স্থাপনে সাফল্য অর্জন করাও বাংলাদেশ মিশনের শান্তি প্রকল্পের অন্যতম কাজ। শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশি নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে একটি মাইলফলক। শান্তি রক্ষা মিশনের দায়িত্বে থাকা হার্ভে ল্যাডসাউ এদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের অবদানের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন।

মূলত দুই দশকের বেশি সময় ধরে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ উত্সাহব্যঞ্জক। শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা মোতায়েনের সংখ্যার বিচারেও অনেক দিন ধরে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে আমাদের দেশ। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমুন্নতি বিধানের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর বিশ্ব শান্তি স্থাপনের ভূমিকাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা দরকার। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অতুল খারের ‘শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ এখন একটি ‘ব্রান্ড নেম’ প্রশংসা সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিল আরো একবার।