বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ বিষয়ে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ লাভ করেছেন_ এটা আমাদের সবার জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের ও গর্বের। পরিবেশ বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ ২০০৭ সাল থেকে বিজ্ঞানী, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। ২০০৮ সালে আমি নিজেও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত অবদানের জন্য। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এই পুরস্কার লাভ করেন, তার তাৎপর্য হয় বহুমাত্রিক। এর প্রভাব দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশ্বসভাতেও পড়ে। এর আগে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ, ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সুসিলো বামবাং যুযুধুনো, মঙ্গোলিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাখিয়া এলবেগদোর্জ এ পদক পেয়েছেন। পরবর্তীকালে তাদের আরও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। যার সুফল পেয়েছে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট দেশ এবং সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় লড়াইরত বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞানী, পরিবেশকর্মী, সর্বোপরি নাগরিকদের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাই।
এ বছর ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ ঘোষণা করে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ওয়েবসাইটে যে খবর দেওয়া হয়েছে, সেখানে তারা বলেছে যে শেখ হাসিনাকে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় নীতিগত ক্ষেত্রে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য। সেখানে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিনিয়োগ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট। প্রতিবেশগতভাবে নাজুক বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সামগ্রিক পদক্ষেপের স্বীকৃতি হচ্ছে এই পুরস্কার।
তাদের এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ। অস্বীকার করা যাবে না যে, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সেদিক থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ছিল বাংলাদেশের জন্য নতুন ক্ষেত্র। কিন্তু তা মোকাবেলায়ও বাংলাদেশের নীতিগত প্রস্তুতি বিশ্বে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ২০০৯ সালে নাপা (ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন) এবং পরে ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি পেপার তৈরি করতে পেরেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালেই ১৩৪ দফা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা না থাকলেও কেবল নৈতিক দায়িত্ব থেকে গৃহীত বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মসূচি স্বল্পোন্নত অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয় হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে বাংলাদেশ যে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার নিজস্ব তহবিল গঠন করেছে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের পক্ষে তাও কম শ্লাঘার নয়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে দুর্যোগ সহনীয় জাতের শস্যও উদ্ভাবন করেছে।
কেবল অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার জন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে যে আলোচনা, দরকষাকষি, অন্য কথায় লড়াই চলছে, সেখানেও শেখ হাসিনা সবসময়ই বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করে এসেছেন। আমার মনে আছে, গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছিলেন, জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলায় সামর্থ্য অর্জনের মহাসড়ক ধরে অগ্রসর হতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কার্বন নির্গমনকারী বৃহৎ দেশগুলোর উচিত এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ কখনও উন্নয়নশীল বিশ্বের গড় মাথাপিছু নির্গমনের সীমা অতিক্রম করবে না বলেও তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। তাও কিন্তু বাধ্যবাধকতা নয়, সদিচ্ছারই প্রমাণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় নীতিগত অবদানের জন্য শেখ হাসিনা এমন সময় এই পুরস্কার পেলেন, যখন গুরুত্বপূর্ণ প্যারিস কোপ আসন্ন। গ্রিনহাউস গ্যাস উদগিরণ কমিয়ে আনতে উন্নত বিশ্ব একটি আইনগত দিক থেকে বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তিতে উপনীত হবে কি-না, তার ফয়সালা হতে পারে এই সম্মেলনে। স্বল্পোন্নত দেশের নেতা হিসেবে বাংলাদেশ এরই মধ্যে এ ধরনের সম্মেলনে, আলোচনায় বিশিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে এসেছে। শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কারণে এবার সে অবস্থান আরও জোরালো হবে।
এই সেপ্টেম্বরে রয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। আমি নিশ্চিত, পুরস্কারটি লাভের জন্য এই অধিবেশনে শেখ হাসিনা বিশেষভাবে অভিনন্দিত হবেন। আমরা দেখতে চাইব, সেখানেও তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বৈশ্বিক উদ্যোগ জোরালো করার তাগিদ দেবেন। বস্তুত এর বিকল্পও নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ঝুঁকিতে যেসব দেশ রয়েছে, বাংলাদেশ নানা বিবেচনায় তার প্রথম সারিতে। অথচ আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস উদগিরণ করি না বললেই চলে। তা সত্ত্বেও আমরা এরই মধ্যে কেবল নীতি ও কাঠামোগত প্রস্তুতি সম্পন্ন করিনি; নিজস্ব অর্থায়নে তহবিলও গঠন করেছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় যে বিপুল অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা তো উন্নত বিশ্বকেই করতে হবে! এজন্য বাংলাদেশকে সবসময়ই তাগিদ দিয়ে যেতে হবে। ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ বিজয়ী একজন প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সেই তাগিদ নিশ্চয়ই বিশেষ গুরুত্ব পাবে। আমরা জানি, জলবায়ু-যুদ্ধে বাংলাদেশ এরই মধ্যে নেতৃত্বের আসনে রয়েছে; এখন সেই আসন আরও দৃঢ়তর হবে। সেই দৃঢ় আসন থেকেই বাংলাদেশ ও বিশ্বের জলবায়ু-যুদ্ধে শেখ হাসিনাকে আরও বৃহত্তর পরিসরে নেতৃত্ব দিতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি বিনয়ের সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই, অভ্যন্তরীণ পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে এই পুরস্কার তার দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিল। আমরা জানি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থায় ক্রমাবনতি দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে সেই অবনতির ধরন, তার কারণ যথার্থভাবে চিহ্নিত। এজন্য প্রয়োজনীয় নীতি, আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা মাঠ পর্যায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এখন শেখ হাসিনাকে সেদিকেও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। পরিবেশ বিষয়ে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি দেশে পরিবেশবিরোধী তৎপরতা চলতে দেওয়া ভালো দেখায় না।
জলবায়ু-যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের স্বীকৃতি
চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ লেখকঃ ড. এ আতিক রহমান, পরিবেশ বিজ্ঞানী