তৃণমূলের নারীদের ‘স্বপ্ন’

লেখক : খায়রুল আলম, গণমাধ্যম ও উন্নয়নকর্মী

গত এক দশকে দেশে নারীর কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে কৃষি ও তৈরি পোশাক খাত। এ দুটি খাতে নারী শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের সহায়ক নীতি, নারীশিক্ষা বাড়ানোয় বিশেষ পদক্ষেপ ও নারীর প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে উদ্যোগ নারীদের কর্মসংস্থান বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া সামাজিক বিভিন্ন প্রচলিত রীতিনীতির পরিবর্তনও সহায়ক ভূমিকা রাখছে। অগ্রযাত্রার এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের সমতায়নের লক্ষ্যে ‘স্বপ্ন’ নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অতিদরিদ্র নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকল্পটির পুরো নাম ‘সম্ভাবনাময় উত্পাদনশীল কাজে নারীদের সমতার উন্নয়ন’। যার আরেক ও সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে (এসডব্লিউএপিএনও-SWAPNO) সংক্ষেপে ‘স্বপ্ন’। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২২টি জেলার ১০৬টি উপজেলার এক হাজার ৩০টি ইউনিয়নের গ্রামীণ অতি দরিদ্র নারীদের স্বনির্ভর করা হবে।

গ্রামে যেসব ঋতুতে কাজ থাকে না, সেসব ঋতুতে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দরিদ্র নারীদের দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মুক্তি দিতেই এ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে দরিদ্র নারীদের দৈনিক ২০০ টাকা করে মজুরি দেয়া হবে। এ মজুরি থেকে দৈনিক ৫০ টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হবে। ফলে দেড় বছরে তার ২৫ হাজার টাকা জমা হয়ে যাবে। পরবর্তী সময়ে এ পুঁজি খাটিয়ে তিনি তার আয় আরো বাড়াতে পারবেন।

এ প্রকল্পের ফলে নারীরা আরো বেশি স্বাবলম্বী হতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নারীদের সমতার উন্নয়নও এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য নির্ণয় করা হয়েছে। এজন্যই প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়েছে ‘সম্ভাবনাময় উত্পাদনশীল কাজে নারীদের সমতার উন্নয়ন’। ‘স্বপ্ন’ প্রকল্পটি নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন হবে এবং তৃণমূলে নারীরা আরো বেশি স্বাবলম্বী হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকার গ্রামীণ নারীর দারিদ্র্য দূরীকরণের স্থায়ী অষ্ট্প হিসেবে স্বপ্ন নামের এই প্রকল্প শুরু করেছে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) লক্ষ্য পূরণে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে ‘স্বপ্ন’।

৮৫৩ কোটি টাকার অনুমোদিত এ প্রকল্পে সরকার ২১৩ কোটি টাকা দেবে। বাকি ৬৪০ কোটি টাকা অনুদান আকারে দেবে ইউএনডিপি। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটির গুরুত্ব উপস্থাপনে স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং এর অধিকাংশই নারী। গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় দরিদ্র এ সব মানুষ শহরে অভিগমন করে থাকে। দেশ জাতীয় প্রবৃদ্ধি এবং মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি লাভ করলেও এখনো দারিদ্র্য ফাঁদ বিদ্যমান। এ ফাঁদ দূর করার জন্য সামাজিক সুরা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে গত দুই দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন হয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এবং উন্নয়ন সহযোগীরা এক সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে এই প্রকল্প তৃণমূল নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক অগ্রযাত্রায় আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে। এদিকে শিশুদের গড়ে তুলতে মায়ের ভূমিকার সার্বিক উন্নয়নে দারিদ্র্য বিমোচনে মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়া মায়েদের জন্য সম্প্রতি ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কর্মসূচি চালু করেছে সরকার।

মহিলাদের মাতৃত্বকালীন সাহায্য-সহযোগিতায় ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ সরকারের একটি বিশেষ কর্মসূচি। এ প্যাকজের সুবিধা পেলে মা ও তার শিশুর জীবন আরও সুন্দর হবে বলে জানা গেছে। দেশের ১০ জেলার ১০ উপজেলায় এ প্রকল্প চলবে।

মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়া ৭শ’ মা এ প্যাকেজের আওতায় সুবিধা পাবেন। স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য দূর করতেই এ ব্যবস্থাটিকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে হাতে নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী এ কর্মসূচি চালু করা হবে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, স্বপ্ন প্যাকেজের আওতাধীন উপজেলাগুলো হলো: গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, গাজীপুরের কালিগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, নাটোরের সিংড়া, নওগাঁর বদলগাছি, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, মেহেরপুরের মুজিবনগর, ভোলার দৌলতখান, নোয়াখালীর চাটখিল এবং কুড়িগ্রামের উলিপুর। এসব উপজেলার প্রথম স্থান অথবা দ্বিতীয় স্বপ্নের মা এমন ৭শ’ দরিদ্র মাকে মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগী হিসেবে স্বপ্ন প্যাকেজের আওতায় নেয়া হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রম জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত রয়েছে আড়াই কোটি শ্রমিক। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখই নারী। এক দশক আগেও তা ছিল মাত্র ৩৮ লাখ। যেখানে কৃষিখাতে পুরুষ শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ সাড়ে ৩ শতাংশ কমছে, সেখানে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বাড়ছে প্রায় ১৭ শতাংশ হারে। সুযোগ তৈরির পাশাপাশি কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রম বিভাজন নারী শ্রমিকের চাহিদাও বাড়িয়েছে। কিন্তু অপর এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, নারীরা কাজ করেন বেশি, মূল্যায়ন ও পারিশ্রমিক কম। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি নারীর সমতায়ন নিশ্চিত একটি বড় বিষয়। এই অবস্থায় স্বপ্ন প্রকল্পটিকে নিয়ে নতুন করে আশার আলো হিসেবে দেখা হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশনসূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত অসহায় নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে সুরা দেয়া সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে কাজের সন্ধানে আসা নারীদের সংখ্যা কমবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, চরম দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।