উদীয়মান রফতানি পণ্য ডেনিম

৫৬২ কোটি ডলার বাজারের হাতছানি

দেশের উদীয়মান রফতানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ডেনিম বা জিনস পণ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে ডেনিমের বিশাল চাহিদার কারণে বাংলাদেশী ডেনিমের চাহিদাও বাড়ছে। ডেনিমের আন্তর্জাতিক বাজার বর্তমানে ৫৬২ কোটি ডলারের। ২০২১ সাল নাগাদ তা ৭০০ কোটি ডলার ছাড়াতে পারে।
এই সম্ভাবনাময় বাজারে বাংলাদেশ যোগান দেয় মাত্র ৩৫০ কোটি ডলারের ডেনিম ও ডেনিম সংশ্লিষ্ট পণ্য। যার কাঁচামালের মাত্র ৪০ শতাংশ যোগান দেয়া হয় স্থানীয়ভাবে। আর ৬০ শতাংশ আসে চীন থেকে। তবে, ডেনিমের অন্যতম প্রধান রফতানিকারক চীনে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তারা বন্ধ করে দিচ্ছে সিএম (কাটিং এ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং)। এখন অধিক মূল্যসংযোজনশীল পণ্যে বেশি মনোযোগী তারা। তাই সুযোগ আসছে বাংলাদেশের সামনে। এমন ক্রমবিকাশমান বাজারে বাংলাদেশের ডেমিনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক ডেনিম উৎপাদক, ক্রেতা-বিক্রেতা আর দেশীয় উদ্যোক্তারা। এজন্য সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন বলে তারা মত দেন।

সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক মেলা উপলক্ষে তাদের সঙ্গে আলাপ করে এমন সম্ভাবনার কথা জানা যায়। বাংলাদেশ সফররত চীনের চাংজু রুনলী টেক্সটাইল লিমিটেডের প্রতিনিধি লিসা জানান, তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বে প্রায় সব নামী-দামী ব্রান্ড এখান থেকে তাদের পণ্য বানায়। তাই ডেনিম পণ্য রফতানিতেও বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তারা ভাল কিছু কারখানা আর বায়িং হাউস করতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি আর ডেনিমের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে এখন চীনের ডেমিন ফেব্রিকস রফতানির প্রধান বাজার হিসেবে তারা বাংলাদেশকে নির্ধারণ করেছেন বলে জানান তিনি। আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের প্রধান রফতানিকারক দেশ চীনে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় তারা বন্ধ করে দিচ্ছে সিএম (কাটিং এ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং) বলে জানান চাংজু লিহুও ওয়েবিয়িং কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধি লি। তিনি বলেন, চীনের রফতানি পোশাক খাতে এখন পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন অধিক মূল্যসংযোজনশীল পণ্যে বেশি মনোযোগী হচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক চেইন শপ আর ব্রান্ডগুলো বাংলাদেশের দিকে মনোযোগী হচ্ছে। নিজেদের ডেনিম কাপড় বিক্রির জন্য তারা বাংলাদেশে আসছেন বলে জানান লি। এটা বাংলাদেশের জন্য সুবর্ণ সুযোগ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ডেনিমের উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সামনে ডেনিমের সম্ভাবনাময় এই সুযোগ এসেছে। এটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কর্মী বাহিনী, অবকাঠামো সুবিধা আর প্রচুর বিনিয়োগ।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্ব বাজারে ডেনিম পণ্যের (জিনসের প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট, ব্লেজার ইত্যাদি) বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ২১০ কোটি পিস। যার মধ্যে বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ১৮ কোটি ৫০ লাখ ডেনিম পোশাক রফতানি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটি ৪৩ লাখ পিস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৪ কোটি ১০ লাখ পিস ডেনিম পণ্য রফতানি করে। ২০১৪ সালে ডেনিম সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় হয় প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার। রফতানিকারকদের ধারণা, আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলারের রফতানি করা সম্ভব ডেনিম খাত থেকে। ডেনিমের প্রধান বাজার হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার চাহিদার যথাক্রমে মাত্র ২২ দশমিক ৮৮ শতাংশ ও ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ যোগান দেয় বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ডেনিম পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয়।

ইউরোপে বেশি ডেনিম পণ্য রফতানি করে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের ডেনিম রফতানির বাজারে এগিয়ে আছে চীন ও মেক্সিকো। তারপর আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্রে জানায়, দেশে ইতোমধ্যে ডেনিম কাপড় তৈরির জন্য প্রায় ৩০টির অধিক কারখানা স্থাপিত হয়েছে। ডেনিম পণ্য তৈরির কারখানা রয়েছে ৫৩১টি। উদ্যোক্তারা এ খাতে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৯০ কোটি ডলার। প্রতিবছর ডেনিম কাপড় উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা ৩৬ কোটি গজ। যেখানে চাহিদা রয়েছে প্রায় ৭২ কোটি গজ। আর আন্তর্জাতিক বাজারের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ৬শ’ কোটি গজ ডেমিন কাপড়। এনভয় ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ডেনিমের আলাদা কোন সিজন নেই। এটা ১২ মাসের পণ্য। বিশ্ববাজারে এর চাহিদাও ব্যাপক।

তিনি বলেন, দেশে ইতোমধ্যে ডেমিন তৈরির ৩০টি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। যাদের ২৮টি ডেনিম তৈরি করছে। বাকি ২টি এখনও উৎপাদনে আসতে পারেনি। গ্যাস না থাকাসহ পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় ডেনিম কম তৈরি হয়। তাই অধিক মূল্যসংযোজনশীল ডেনিম পণ্য তৈরির দিকে জোর দেয়ার কথা বলেন তিনি। বিশেষ করে ফ্যাশনেবল ডেমিনের উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে জোর দিয়ে সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘ডেনিমে রয়েছে লুকায়িত সৌন্দর্য। যত ড্রাইং হবে, তত এর সৌন্দর্য বিকশিত হবে।’ ডেনিমের এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে নতুন নতুন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা দরকার বলে মত দেন আরগন ডেনিম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রি করার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এনার্জি সঙ্কট। এখানে চাইলে কোন ইন্ডাস্ট্রি গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ করে তিনি বলেন, সরকার তার স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা না বলেই হঠাৎ করে বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। এত শিল্প উদ্যোগক্তারা হুমকির মুখে পড়ে।

আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকারের নীতি নির্ধারকদের আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি চান? নতুন নতুন ইন্ডাস্ট্রি গড়ার সুযোগ দিতে হলে স্বল্প দামে এর সহায়ক সব সুবিধা দিতে হবে। বিশেষ করে ডেনিম বা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির জন্য এনার্জি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এটা স্বল্প দামে না পেলে ইন্ডাস্ট্রি হবে না। বিদ্যমান ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে যদি এনার্জির লোড না বাড়ানো যায়, তাহলে তাদের উৎপাদন বাড়বে না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে করে এসব ইন্ডাস্ট্রিও সিক হতে বাধ্য হবে।