যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণে নতুন মাইলফলক

বৃহদাকারের দুটি যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের মাধ্যমে খুলনা শিপইয়ার্ড দেশের নৌ-নির্মাণশিল্পে নতুন মাইলফলক অতিক্রম করতে যাচ্ছে। আজ দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনা শিপইয়ার্ডে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর জন্য দুটি ‘লার্জ পেট্রোল ক্রাফট-এলপিসি’র কিল্ললে’র মাধ্যমে এর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ইয়ার্ডটিতে নির্মিত ১টি কন্টেনারবাহী নৌযানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলেও আশা করা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থে প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে আগামী ৩০ মাসের মধ্যে খুলনা শিপইয়ার্ড দুটি এলপিসি’র নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করবে। দেশের নৌ-নির্মাণশিল্পে এটিই এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ কর্মকা-। ‘সামুদ্রিক নীল অর্থনীতি’তে এসব কন্টেইনারবাহী নৌযান বিশেষ অবদান রাখবে। নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এ শিপইয়ার্ডটিই প্রথম দেশের উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ নৌপথের জন্য এ ধরনের বিশেষায়িত নৌযান নির্মাণকাজ সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করল। উপমাহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ নৌ-নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটিতে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশ সামরিক-বেসামরিক নৌযান নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইতোমধ্যে। ব্রুনাই ও ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের নৌবাহিনী প্রধানরা ইতোমধ্যে খুলনা শিপইয়ার্ড পরিদর্শন করে অভিভূত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিরাষ্ট্রীয়করণ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড ১৯৯৯ সালে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পরে শত কোটি টাকার দায় দেনা কাটিয়ে গত ১৫ বছরে আরো প্রায় সোয়া ২শ’ কোটি টাকা নিট মুনফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষসহ এর কমকর্তা-কর্মচারীদের সততা ও আন্তরিকতার পাশাপাশি দক্ষতার কারণেই খুলনা শিপইয়ার্ড আজ গোটা জাতীর সামনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান-আইএসও’র সনদ লাভকারী খুলনা শিপইয়ার্ড বিশ্ব সেরা নৌনির্মাণ-পরামর্শক ও জরিপ প্রতিষ্ঠান জাপানের এনকে, ফ্রান্সের ব্যুরো অব ভেরিটার্স ছাড়াও লয়েডস, সিসিএস ও জিএল-এর মতো বিশ্বে সেরা নৌ-নির্মাণ পর্যবেক্ষণ ও সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের তত্ত্বাবধানে কাজ করারও গৌরব অর্জন করেছে। গত অর্থ বছরে খুলনা শিপইয়ার্ড এযাবৎকালের সর্বোচ্চ প্রায় ৫৯ কোটি টাকা কর পূর্ব মুনাফা অর্জনের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এমনকি বাংলাদেশ নৌবাহিনী অধিগ্রহণের পরে গত ১৫ বছরে শিপইয়ার্ডটির বার্ষিক টার্নওভার ১৬ কোটি থেকে ১৭১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হার ১০.৬৯ গুণ। খুলনা শিপইয়ার্ড এ পর্যন্ত ৬৯৬টি নতুন নৌযান নির্মাণ ছাড়াও ২ হাজার ১৬৮টি নৌযানের মেরামত সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করেছে। যারমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব গ্রহণের পর পন্টুন ও বার্জসহ ১১৫টি নতুন নৌযান নির্মাণ এবং ৫১৮টির মেরামত সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শিপইয়ার্ডটিতে বর্তমানে দুটি সাবমেরিন টাগ ছাড়াও বিআইডব্লিউটিসি’র জন্য ২টি কন্টেইনার জাহাজসহ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য আরো দুটি কন্টেইনার কাম কার্গে শিপ নির্মাণাধীন রয়েছে।জাপানের নৌ জরিপ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ক্লাস এনকেকে’র তত্ত্বাবধানে চীনা কারিগরি সহযোগিতায় টর্পোডো, এন্টি এয়ার ক্রাফট গান ও মিসাইলসমৃদ্ধ যুদ্ধজাহাজ নির্মাণকাজ সম্পন্নের মাধ্যমে খুলনা শিপইয়ার্ড সমর শিল্পে উপমহাদেশের বিশেষ অবস্থান করে নিতে পারবে বলে আশা করছেন ওয়াকিবহাল মহল। এসব যুদ্ধ জাহাজ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে শত্রুর লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার মতো মিসাইলসহ সমর সরঞ্জাম সংযোজন করা হবে। প্রায় ২১০ ফুট দৈর্ঘ ও ৩০ ফুট প্রস্থ এবং প্রায় ১৪ ফুট গভীরতার এসব নৌযান ঘণ্টায় প্রায় ২৫ নটিক্যাল মাইল বা প্রায় ৪৭ কিলোমিটার বেগে সাগর ও উপকূলের লক্ষ্যস্থলে চলতে সক্ষম হবে। এসব যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হলে তা দেশের সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেবে। প্রতিটি যুদ্ধ জাহাজে ৭০ জন করে নৌসেনা ও নাবিক থাকবে। এর আগে খুলনা শিপইয়ার্ড সাফল্যজনকভাবে আরো ৫টি পেট্রোল ক্রাফট নির্মাণের গৌরব অর্জন করে। ২০১১-এর ৫ মার্চ ঐসব পেট্রোল ক্রাফট-এর ‘কিল্ললে’র মাধ্যমে নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ৫টি পেট্রোল ক্রাফটই নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর শেষে তা কমিশন করা হয়। এদিকে আজ একই সাথে খুলনা শিপইয়ার্ডে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ‘নৌ কল্যাণ ফাউন্ডেশন’র জন্য নির্মিত দুটি কন্টেইনারবাহী জাহাজের প্রথমটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় আড়াইশ ফুট দৈর্ঘ ও ৪৫ ফুট প্রস্থ এসব কন্টেইনারবাহী জাহাজ ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ১৪০টি করে কন্টেইনার বহন করতে সক্ষম। নৌযান দুটি চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জের ‘পানগাঁও ইনল্যান্ড কন্টেইনাল টার্মিনাল’এ কন্টেইনারসমূহ পৌঁছে দেবে। ১৩ ফুট গভীরতার এসব নৌযানে ৬শ’ অশ্বশক্তির ২টি করে মূল ইঞ্জিন ছাড়াও ১২৬ কিলোওয়াট ক্ষমতার ২টি করে জেনারেটরও সংযোজন করা হয়েছে। ১০ নটিক্যাল মাইল বেগে দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌপথ পাড়ি দিয়ে পানগাঁও-এ কন্টেইনারসমূহ দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দেবে এসব নৌযান। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এসব বিশেষায়িত নৌযান ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যন্স অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে বলে জানা গেছে। দেশে প্রথমবারের মতো নির্মিত এসব কন্টেইনারবাহী নৌযানের জন্য সিঙ্গাপুরের ‘সি কোয়েস্ট’-এর ডিজাইন হাউজ থেকে নকশা প্রণয়ন করা হয়। ‘জাপানিজ ক্লাসিফিকেসন সোসাইটি-এনকে’র মাধ্যমে তা অনুমোদন করাসহ তাদের তত্ত্বাবধান ও পরামর্শে এসব কন্টেইনারবাহী নৌযান নির্মিত হয়েছে। দ্বিতীয় কন্টেইনারবাহী নৌযানটির নির্মাণকাজও ইতোমধ্যে প্রায় শেষের পথে। ইতোমধ্যে নৌযানটি নদীতে ভাসানো হয়েছে। চূড়ান্ত পরীক্ষামূলক পরিচালনসহ অবশিষ্ট কাজসমূহ সম্পন্ন করার পরে তা নৌকল্যাণ ফাইন্ডেশনের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। নিরাপত্তায় ২ হাজার পুলিশ ও র‌্যাবের আটটি টিম টানা দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম খুলনা সফর। গত ২ বছর আগে তিনি সর্বশেষ খুলনায় এসেছিলেন। এবারের সফরকে সামনে রেখে মহানগর জুড়ে নেয়া হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দায়িত্ব পালন করবে পুলিশের ২ হাজার সদস্য ও র‌্যাবের আটটি বিশেষ টিম। এছাড়া থাকবে সাদা পোশাকধারী পুলিশও। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা শুক্রবার বিকেল থেকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে ৫ কিলোমিটার পথজুড়ে মানবপ্রাচীর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ। মহানগরীর নেভি গেট থেকে শিপইয়ার্ড পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে সব ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাবেন।র‌্যাব-৬ পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে ইতোমধ্যে মহানগরীতে র‌্যাবের বিশেষ টিম টহল শুরু করেছে। রোববার নগরীতে র‌্যাবের আটটি বিশেষ টিম টহলে থাকবে। এছাড়া মংলা থেকে মহানগরী পর্যন্ত র‌্যাবের টিম নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে।খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) মুখপাত্র বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু জানান, সফরের দিন মহানগরীতে ২ হাজার পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে।