প্রতিকূল পরিবেশেই এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতুর কাজ

বর্ষায় দুরন্ত পদ্মার মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার চিত্র আবহমানকালের। আছড়ে পড়া বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে সবকিছুই গ্রাস করতে চায় সে। এমন প্রতিকূল পরিবেশেই চলছে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর কাজ। কয়েকদফা নদীভাঙন আর তীব্র সে াতের কারণে চাইলেও দ্রুত কাজ করা যাচ্ছে না। তবুও এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতুর কাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৮ সালের মধ্যে এ স্বপ্নের সেতু দিয়ে পারাপার হতে পারবেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা।

মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যেই হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। দ্বিতল এই সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর নিচ দিয়ে যাবে রেল। সেতুর ব্যয় আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। সর্বশেষ এর ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত মূল সেতুর ১০ শতাংশ আর গড়ে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ২৩ শতাংশ।

মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক মিলে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ নানাভাবে যুক্ত পদ্মা সেতুর কাজের সঙ্গে। গত শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, দিনরাত ভুলে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। মাওয়ার কুমারভোগে নদীর পাড়ে বিশাল নির্মাণ মাঠে (কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড) মূল সেতুর মালামাল রাখা হয়েছে। যন্ত্রপাতি রাখা ও ঠিকাদারি কোম্পানির লোকজনের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে বড় বড় শেড। দুটি জেটি রয়েছে নদী থেকে মাঠে মালামাল তোলার জন্য। তিনটি ড্রেজার, একটি বহুমুখী কাজের জাহাজ, একটি টাগবোট, তিনটি অ্যাঙ্কর বোট, ২৫টি কন্টেইনার ও প্রায় ৫০০ ড্রেজিং পাইপ প্রকল্প এলাকায় বসানো হয়েছে।

মাঝ নদী থেকে শুরু করে নদীতীরের চারপাশ, সেখান থেকে আরও দেড় কিলোমিটার দূরে চলছে নির্মাণকাজ। ভারি ভারি নির্মাণযন্ত্র দিয়ে চলছে পাথরভাঙা, মাটিকাটা, মাটি ভরাট ও রাস্তা সমান করার কাজ। বিশাল স্তূপাকারে রাখা হয়েছে পাথর, বালু। ভাঙন ঠেকাতে নদীতে রাখা আছে বালির বস্তাভর্তি সারি সারি নৌকা। বিশাল আকৃতির পাইল তৈরির জন্য ওয়েল্ডিংয়ের শব্দ আর আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। এই কর্মযজ্ঞে পদ্মা পাড়ে চলছে উত্সবের আমেজ। মাওয়া চৌরাস্তা বরাবর আগে যেখানে ফেরিঘাট ছিল সেদিক দিয়েই হবে এই সেতু। এ জন্য সেখান থেকে ফেরিঘাট সরিয়ে আড়াই কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়ায় স্থানান্তর করা হয়।

কয়েকদিন আগেও তীব্র সে াতে তলিয়ে গেছে কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডের একটা অংশ। নির্মাণ সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতিও ভেসে গেছে সেই সে াতের তোড়ে। ভেঙে যাওয়া অংশ বাঁশ আর বালিভর্তি ব্যাগ দিয়ে মেরামতের চেষ্টা চলছে। এর আগেও কয়েক দফা ভাঙনের শিকার হয়েছে নির্মাণ এলাকা। একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে চোখে পড়ে বিশাল আকৃতির পাইল। সঙ্গেই ওয়ার্কশপ-সেখানে এই পাইল তৈরির কাজ চলছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের এক প্রকৌশলী জানালেন, এই পাইলের ওপরই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। স্টিলের তৈরি প্রতিটি পাইলের ডায়ামিটার তিন মিটার। নদীর তীরে পাইলের উচ্চতা ১১৭ মিটার (প্রায় ৩৮০ ফুট)। আর মাঝখানে থাকবে ১০১ মিটার। নদীপথে চীন থেকে আনা বিশাল পুরু স্টিলের পাত ওয়ার্কশপের কাছে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ক্রেন দিয়ে তা একটা একটা করে আলাদা করা হচ্ছে। এরপর বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে খণ্ড খণ্ড টিউব বা পাইপের মতো তৈরি করা হচ্ছে। এমন অনেক টিউব একসঙ্গে ওয়েল্ডিংয়ের মাধ্যমে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল আকৃতির পাইল। মাঝ নদীতে চলছে মূল সেতুর পাইলের আদলে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ।

জানা গেল, এমন দুটি পাইলিং করা হবে-মূল পাইলিংয়ে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে তা পর্যবেক্ষণ করতেই এটা করা হচ্ছে। নদীর মাঝখানে পাইলিংয়ের কাজ দেখতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রকল্পের এক প্রকৌশলী জানালেন, নদীতে এখন সে াতের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে চার মিটার। এমন অবস্থায় সেখানে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
আমাদের আগ্রহে একপর্যায়ে তিনি রাজি হয়ে বললেন, ‘ঢাকায় বসে আপনারা পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কিছুই লেখেন। সেজন্যই বাস্তবে সব চোখে দেখা দরকার। ওখানে গেলেই বুঝবেন কতটা অনুকূল পরিবেশ।’ তাঁর সঙ্গে কথা শেষ করে স্পিডবোটে চড়ে রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হল ওই প্রকৌশলীর কথা আসলেই সত্যি। বিশেষ করে পাইলিং যেখানে হচ্ছে তার কাছে যেতেই চোখে পড়ে বিশাল বিশাল আকৃতির ঢেউ।

উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি ক্রেন ভাসমান বার্জে বসিয়ে পাইলিংয়ের কাজ চলছে। জার্মানির তৈরি ৪৭০ টন ক্ষমতার হাইড্রোলিক হ্যামার (হাতুড়ি) দিয়ে নদীর নিচে পাইল বসানো হচ্ছে। অত্যাধুনিক এই হাতুড়ি ৩৬০০ টন চাপ প্রয়োগ করতে পারে বলে জানান মূল সেতুর কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী। প্রকৌশলী জানান, তীব্র সে াতের কারণে পাইলিংয়ের অবস্থান ঠিক থাকছে না। ফলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পাইলিংয়ের কাজে বেশি সময় লাগছে।

প্রসঙ্গক্রমে বলেন, আগে যদি একটা কাজ করতে এক ঘণ্টা সময় লাগত এখন সেই কাজ করতে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় লাগছে। তারপরও কাজ থেমে নেই। প্রতিটি পাইলিংয়ে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে বলেও তিনি জানান। এর আগে গত পয়লা মার্চ অ্যাঙ্কর পাইল বসানোর কাজ শুরু হয়। আর ২০ মার্চ শুরু হয় পরীক্ষামূলক পাইলের কাজ। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক পাইলের ওপর প্রায় আড়াই হাজার টন ওজনের চাপ দেওয়া হয়েছে যথাযথভাবে বহন করতে সক্ষম হয় কি না তা দেখার জন্য। এ ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য পাওয়া গেছে।

প্রকল্পের জন্য মোট ১৪০৮.৫৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নৌযান চলাচলের জন্য পানি থেকে সেতুর উচ্চতা হবে ১৮.৩ মিটার। পদ্মা সেতুতে থাকবে ৪১টি স্প্যান (দুই পিলারের মধ্যবর্তী স্থান)। দুটি স্প্যানের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৫০ মিটার। মূল সেতুর ৪০টি পিলারে ছয়টি করে ২৪০ এবং দুই পাড়ের দুটিতে ১২টি করে ২৪টি, অর্থাত্ ২৬৪টি পাইল করতে হবে। এ পর্যন্ত ১০টি পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে তিনটির। ১২টি ভায়াডাক্টের মধ্যে শেষ হয়েছে চারটির।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সেতুর পুরো কাজ প্রধান পাঁচভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হল-জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, নদী শাসন, মূল সেতু, দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো (সার্ভিস এলাকা) নির্মাণ। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই সেতুর মূল কাজ করছে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (এমবিইসি)। গত বছরের ১৭ জুন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার চুক্তি সই হয়। কার্যাদেশ দেওয়া হয় একই বছরের ২৬ নভেম্বর। নিয়োগের পরই মূল চুক্তির ১৫ শতাংশ অর্থ দেওয়া হয় ঠিকাদারকে। চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। আগামী অক্টোবরে শুরু হবে সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজ। আগামী বছর মে মাসে খুঁটির ওপর সেতুর স্প্যান বসানো শুরু হবে।

নদীভাঙন ঠেকাতে নদীর দুই তীরে ১৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী শাসনের কাজ করছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। গত বছরের ১০ নভেম্বর চুক্তি আর ওই বছরেরই ৩১ ডিসেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকার এই চুক্তির কাজের মেয়াদ চার বছর। মাওয়া ও জাজিরার দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক এবং অন্যান্য অবকাঠামোর নির্মাণকাজ যৌথভাবে করছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট। সেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম সকালের খবরকে বলেন, সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর ২৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। আগামী বছরই মূল সেতু দৃশ্যমান করা যাবে। আর ২০১৮ সালের মধ্যেই সেতুটি চালু হবে বলে তিনি দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেন। নদীভাঙনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদী ভাঙবে এটা স্বাভাবিক। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সবকিছু পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে সেতুর কাজ বিলম্বিত হবে না।

নদীভাঙনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এর দায়ভার কে বহন করবে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলতে পারবে। আমরা কাজের জন্য তাদের ওই জায়গা দিয়েছি। তারা সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই কাজের চুক্তি করেছে। সুতরাং ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানেরই।’বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতার পর ২০১২ সালে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এর আগে ২০১১ সালে একবার প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। পদ্মা সেতুর মূল প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছিল ২০০৭ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।