বাংলাদেশের বন্ধু-প্রতিম রাষ্ট্র জার্মানি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে ছিল তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এবং স্বাধীনতার পর পরই দুই জার্মানি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় জার্মানি বরাবরই সহযোগিতা দান করে আসছে। এই সহযোগিতা বর্তমানেও অব্যাহত আছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বস্ত্র-শিল্পের উন্নয়নে নানা মাত্রিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে জার্মান উন্নয়ন সহযোগিতা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হান্স ইওযাখেম ফুশটেলের সঙ্গে কথা হয় এই নিবন্ধকারের।
বুন্ডেস মিনিসটিরিউম ফুইর সুজামেন আরবাইট সংক্ষেপে বি.এম.জেড অর্থাত্ জার্মান উন্নয়ন সহযোগিতা মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সাথে বাংলাদেশে কাজ করছে। বাংলাদেশের এই কাজের মূল লক্ষ্য কি—জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী ফুশটেল জানান, ১৯৭১ এ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এই দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার হচ্ছে জার্মানি। জার্মানির চার্চ, অসংখ্য এনজিও এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। জার্মান উন্নয়ন সংস্থার ৫০টি অংশীদার দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং যার সঙ্গে তারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। জার্মানি বাংলাদেশে যে সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে তার মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি এবং তার দক্ষতা, শহর অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, সুশাসন ও মানবাধিকার এবং আইনের শাসন। গত বছর নভেম্বর মাসে এ সকল ক্ষেত্রে অনুদান হিসেবে ২১১ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের একটি ক্ষেত্র বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো ও ভবনের সুরক্ষার ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগকে অগ্রান্বিত করার জন্য কাজ করছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন বিষয়ক জার্মান মন্ত্রী গার্ড মূলার দেশের সরকার, সুশীল সমাজ এবং উত্পাদনকারীর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে বস্ত্রখাতে উন্নত সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই জন্যই মন্ত্রী মূলার গত বছর টেকসই বস্ত্রখাতের জন্য দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সূচনা করেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় টেকসই এবং দায়িত্বপূর্ণ পন্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তারা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে বলে জানান। গত বছর তিনি দু’বার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন যা ছিল খুবই সফল। আমি অনেকগুলো ইতিবাচক কর্মকাণ্ড এবং উন্নতি লক্ষ্য করেছি। আমি মিলিত হয়েছি নতুন নিযুক্ত সরকারি পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে—যাদেরকে জার্মানি প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতি সহযোগিতা করেছে এবং আমরা আমাদের বাংলাদেশি সহযোগীদের সঙ্গে নতুন ব্যবস্থা স্থাপন করেছি। বাংলাদেশে ৬টি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান টেকসই বস্ত্রখাত বিষয়ক দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতায় চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ যা মন্ত্রী মূলার শুরু করেছেন। মিলিতভাবে ঐ কোম্পানিগুলো ৩৬,৩৭১ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান এবং বার্ষিক ৮৬৫ মিলিয়ন ইউরো ব্যবসা করে। এক্ষেত্রে স্টকহোল্ডাররা কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষা, উপযুক্ত পারিশ্রমিক এবং পরিবেশ বান্ধব উত্পাদন ব্যবস্থার বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এটা কেবল ব্যবসায়িক, সামাজিক দায়বদ্ধতাই প্রদর্শন করে না, বরং উন্নত ব্যবসায়িক সচেতনতার সৃষ্টি করে। কারণ জার্মান ক্রেতারা এ ধরনের অঙ্গীকারকে পুরস্কৃত করতে প্রস্তুত যদি তা বিশ্বাসযোগ্য হয়।
আমরা অনেক বছর ধরেই বস্ত্রখাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে আসছি। অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন বিষয়ক মাননীয় জার্মান মন্ত্রী এ খাতে বিভিন্ন প্রকল্পে দশ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করেছেন। ২০১০ সাল থেকে প্রায় ১ লাখ শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপকরা আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেছেন, স্থাপনা এবং সাধারণ নিরাপত্তা বিষয়ে পরিদর্শকরা প্রশিক্ষণ এবং সাহায্য গ্রহণ করেছেন। গত বছর নভেম্বর মাসে আমরা ফলোআপ প্রকল্পের জন্য ৬ মিলিয়ন বরাদ্দে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি।
গ্রিসে কিছু বিস্ময়কর সাফল্যের পর বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে তিনি মনে করেন বাংলাদেশের সমস্যা এবং গ্রিসে যে বিষয়গুলোর তিনি সম্মুখীন হয়েছেন তার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। গ্রিসের ক্ষেত্রে তারা শুধু ইউরোপীয় আদর্শ এবং দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সমভাগী নন বরং তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সদস্য হিসেবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ বাজারের মাধ্যমে সম্পর্কভুক্ত। গ্রিসের নিজেকে সাহায্য করার প্রচেষ্টা ক্রমান্বয়ে সাফল্য লাভ করেছে। আমরা ভুলে যাই যে ইউরোপের প্রাচীন অনেক দেশ যার আছে ইউরোপীয় মূল্যবোধ এবং উন্নয়নের ধ্রুপদি ঐতিহ্য, গ্রিসের অভিজ্ঞতা থেকে তারা এটাও শিক্ষা পায় যে, বড় প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার সফল সংস্কার হলো একতার শক্তি এবং উন্নয়ন অর্জনের চাবি-কাঠি। অবশ্য বাংলাদেশ উঠতি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হবার লক্ষ্যস্থির করেছে। এ দেশের অর্থনীতি গতিশীল ধারার বিকাশ লাভ করছে এবং দরিদ্রতা দূরীকরণ ও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্থপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করেছে।
আমরা ২০১৫ সালে এগিয়ে যাচ্ছি। এ বছরই আমরা একমত হবো, এ বিশ্বের জন্য আর কি কি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা চাই এবং আর কি কি সহযোগিতা একটা দেশ করতে চায় এবং পারে। জার্মানি এবং বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করছে। তিনি জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে জানান যে, তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং আগের মতই সকল উন্নয়ন সহযোগিতা বজায় থাকবে।