সুন্দর বাইরেটা, অগোছালো ঘরে হারিয়ে যায়- সুভাষ মুখোপধ্যায়ের কবিতার লাইনটা আজকের কলামটা লেখার সময় কেবলই মনে পড়ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হচ্ছে; এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী যদি দলের বাইরে তাকিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে, তবে তার মনে প্রশান্তি সৃষ্টি হতে বাধ্য। কেননা বাইরেটা সুন্দর। অঙ্গীকার অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। পত্রপত্রিকা লিখছে, মহাপরিকল্পনা নিয়ে রূপকল্প বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বড় বড় সব পরিকল্পনা। কোনোটার কাজ অগ্রসর হচ্ছে, কোনোটার পরিকল্পনার চূড়ান্ত, কোনোটার আবার পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। দেশের ইতিহাসে আগে আর কখনো এত বড় ও আধুনিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেয়া হয়নি। প্রকল্পগুলোর কথা দেশবাসী কমবেশি সবার জানা। তবুও এখানে ১০টি মহাপ্রকল্পের উল্লেখ করা হচ্ছে এই জন্য যে, প্রচারের অভাবে অনেক কিছুই আউট অব সাইট থেকে আউট অব মাইন্ড হয়ে যায়। জানা যায়, নিম্নলিখিত কাজগুলোসহ অন্যান্য প্রকল্প তদারকির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে।
এক. পদ্মা সেতুর কাজ পরিকল্পনামতো অগ্রসর হচ্ছে। যে সব নিন্দুক বা হতাশাবাদী ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়, তাদের মুখে ছাই দিয়ে দেশের বৃহত্তম এই স্থাপনা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। সময়ের আগে ২০১৮ সালের মধ্যে স্বপ্নের এই সেতু ব্যবহার করা যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। দুই. ঢাকা ও চট্টগ্রামে বড় বড় উড়াল সেতু, যা ছিল এতদিন কথায় তা এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে। একের পর এক ফ্লাইওভাবের পর শান্তিনগর-মালিবাগ-মগবাজার-ইস্কাটন, সাত রাস্তার মোড় জুরে বিশাল ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ অগ্রসর হচ্ছে। তিন. ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ শুরুর তৎপরতা প্রত্যক্ষ করে মানুষ আশান্বিত হয়ে উঠছে। ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল নির্মাণ শেষ হলে ঢাকার চেহারাই যাবে পাল্টে। চার. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা ছিল ৬০ বছর আগের পরিকল্পনা, তা এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। দেশ আনবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন যুগে প্রবেশের দিন গুনছে। তাছাড়া নির্মিত হচ্ছে দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। লোডশেডিং কথাটা যেখানে ছিল মানুষের অনবরত বুলি, তা এখন ক্রমে মঙ্গার মতোই অতীতের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। পাঁচ. গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির মাস্টারপ্লানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় অগভীর সমুদ্রবন্দর, যা নির্মিত হবে পায়রায়। ছয়. কর্ণফুলীতে ট্যানেল নির্মাণ এখন আর দিবাস্বপ্ন নয়। সাত. কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আট. পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের মিরশ্বরাই ও আনোয়ারা, মৌলভীবাজার ও বাগেরহাটের মংলায় চারটি বিদেশি অর্থায়নে এবং সিরাজগঞ্জে নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করা হবে। নয়. পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কানেকটিভিটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। দশ. সবচেয়ে সাড়া জাগানো প্রকল্প হচ্ছে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন। ২০১৭ সালের মধ্যে যদি এটা স্থাপিত হয়, তবে মহাবিশ্বে যাবে বাংলাদেশ এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় পরনির্ভরতা শেষ করার সুযোগ অবারিত হবে।
উল্লিখিত দশটি কাজ দশ দিকে দশ হাতে যখন বাস্তবায়ন করার কর্মযজ্ঞ চলছে, তখন ক্রমেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার রূপকল্প হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে এবং সমুদ্রে বিজয়ের সুফল করায়ত্ত করতে ‘ব্রু ইকোনমি’ আর অন্য দিকে পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে যে সুসস্পর্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে একে পুঁজি করে আঞ্চলিক সহযোগিতাপূর্ণ অর্থনীতি দেশের উন্নয়নের স্বার্থে কিভাবে হাতের মুঠোয় আনা যায়, সেই পরিকল্পনা প্রণয়নের তৎপরতা চলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সব বড় বড় প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করে উন্নত এক বাংলাদেশ যদি গড়তে হয়, তবে সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক। গ্রেনেডবাজি, বোমাবাজি ও আগুনবাজি প্রভৃতি জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যদি চলতে থাকে, তবে যে উল্লিখিত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড কল্পনার ফানুস হয়ে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বিচারে বলা যায়, দেশে এখন উল্লিখিত সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো রাজনৈতিক পারিবেশ বিরাজ করছে। হরতাল-অবরোধ যা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী, তা এখন বিএনপি-জামায়াত জোটের চরম ভুল তথা সংবিধানবিরোধী-গণবিরোধী-দেশবিরোধী রাজনীতির জন্য দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করছে।
বিএনপি এখন কার্যত সংবাদ মাধ্যমের দল হয়ে গেছে। এতেও নেই স্বস্তি। নেত্রীর নামে বিবৃতি দিয়ে বিবৃতি প্রত্যাহার করে আবার সেই বিবৃতিই প্রচার করার মতো অবস্থা এখন বিএনপির। নেত্রী খালেদা জিয়া যা বলেন, তা অনেকটাই ভাঙা কলের গানের মতো চর্বিত চর্বন, মানুষের কথা সেখানে থাকে না। মানুষ তাই এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্যও করে না। আর ‘লন্ডনের ভাইয়া’ একেবারেই নীরব হয়ে গেছেন। এত ইতিহাস যিনি রচনা করলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসে বড় স্ক্রিনে অডিও-ভিডিও কনফারেন্স করে প্রতিনিয়ত নির্দেশ দিলেন, মানুষকে ঝলসিয়ে দিতে যিনি সালাউদ্দিন গংদের দিয়ে গোপন সংবাদ কেন্দ্র খুলে প্রতিদিন বিবৃতি দিয়ে হরতাল-অবরোধ চালু রাখলেন এবং সর্বোপরি যুদ্ধ জয়ের হুংকার দিতে থাকলেন, তিনি আজ নীরব। নেত্রীর লন্ডন যাওয়া নিয়ে কতই না তোড়জোড় বিএনপির কিন্তু এখন তা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য নেই। গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর পরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকর করতে গিয়ে দল ও জোট এখন যেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও কর্মসূচি গ্রহণও ভুলে গেছে। সুদীর্ঘ ৯ মাস পর ২০ দলীয় জোটের বৈঠক দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চললেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। বিএনপি সুকৌশলে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে নীরবতা পালন করছে বলে একটা প্রচার রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে। বলাই বাহুল্য, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও প্রতিহিংসা দিয়ে আপাদমস্তক মোড়া এই দল ও জোট ঘাপটি মেরে বসে থাকার কারণ যদি এটা হয় যে, অসংবিধানিক কিছু একটা করার নীলনক্সা করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে এই চক্র; তবুও এটাই বলতে হবে, পাপে নিমজ্জিত বিএনপি দল বা জোট হিসেবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু করার মতো অবস্থায় নেই। দল বিধ্বস্ত ও গণবিচ্ছিন্ন। মানুষ এখন উন্নয়ন চায়, নিশ্চিত জীবন-জীবিকার গ্যারান্টি চায়। এ কারণেই করছে বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান।
বিএনপি-জামায়াত জোটের অবস্থা এবং জনগণের মনোভাব উল্লিখিত ধরনের হওয়ায় আওয়ামী লীগ সুন্দর একটি পরিবেশ পেয়েছে দলটির নির্বাচনী অঙ্গীকার সময়মতো বাস্তবায়ন করে এটা প্রমাণ করার জন্য যে, মুক্তিযুদ্ধে যে দল নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দলই পারে জাতিকে অব্যাহত উন্নয়ন দিতে, জীবন-জীবিকার সুদূরপ্রসারী নিশ্চয়তা দিতে এবং সর্বোপরি উন্নত-সমৃদ্ধ-কল্যাণমুখী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। স্বাধীনতার পরে আর কখনো ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ বাইরে এমন পরিবেশ পায়নি। তবে এই পরিবেশ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে; কারো ভুল বা দয়ায় এমনটা নয়। জাতির অগ্রগতির পথে কলঙ্ক হিসেবে চেপে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদান, বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের প্রধান চাবিকাঠি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে আনা, বিএনপি-জামায়াতের যুদ্ধংদেহী অপতৎপরতা ঠেকানো, উগ্রজঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার সাফল্যের ভেতর দিয়ে পরিবেশ উন্নয়ন উপযোগী হয়েছে। স্বাধীনতার বিশেষত পঁচাত্তরের পর থেকে বিগত নির্বাচনের আগ পর্যন্তও চিন্তা করা যায়নি, এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এক কথায় বলা যায়, এটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত জোট সরকারের কাক্সিক্ষত ও কষ্টার্জিত অর্জন এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি-প্রতিজ্ঞা-সাহস-কৌশলের সম্মিলিত যোগফল।
এইভাবে কবির ভাষায় বাইরেটা যখন সুন্দর, তখন কখনো মনে হচ্ছে দল তালের মধ্যে আছে আবার কখনো মনে হচ্ছে বেতালের মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কতক ঘটনায় বিশেষত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্ত্রী নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সুন্দর ও যথাযথ সমাধান, ছাত্রলীগের সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে সমালোচনাহীন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, নতুন মন্ত্রী নিয়োগ, কেন্দ্রসহ জেলা ও তৃণমূলের সম্মেলন এবং সর্বোপরি জাতির পিতার জন্ম দিন পালন সম্পর্কে উদাত্ত ঘোষণা প্রভৃতি যখন কমবেশি এক সঙ্গে চলতে থাকে, তখন এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে, এবারে ঘরের ভেতর থেকে আর তাল তেমন বড়ভাবে কাটবে না। কিন্তু দেখা গেল, যথা পূর্বং তথা পরং। প্রতিবারের মতোই আশা জাগিয়ে আবার নিরাশার দোলা, ঠিক যেন পেন্ডুলামের মতো। এটা অস্বীকায় হবে যে, যদি তাল-বেতালের খেলা পেন্ডুলামের মতো চলতে থাকে, তবে তাল নয়, বেতালটাই বেশি মনে পড়বে। এটা ঠিক গান শোনার মতো ব্যাপার, তাল থেকে বেতালটাই মনে থাকে বেশি। বেতাল গান শুনলে যেমন হয় মন খারাপ, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে এমন তালকাটা একদিকে সপক্ষের জনগণকে উদ্বিগ্ন ও হতাশ করছে আর অন্যদিকে বিধ্বস্ত ও বিচ্ছিন্ন থাকা বিএনপি-জামায়াত জোটের সমর্থকদের মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখছে। সার্বিক বিচারে বাইরের ঔজ্জ্বল্যকে আড়াল করে দিচ্ছে ঘরের জঞ্জাল।
গত রাতে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় নিউজ শুনিনি। অন লাইনের পত্রিকাও দেখিনি। আজ সকালে কলামটা এতটুকু লেখার পর অনলাইনের পত্রিকা খুলতেই চোখে পড়ল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দলের ‘আগাছা’ উপড়ে ফেলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতেই হবে। এতটুকু পড়ে উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। তারপর পড়লাম, তিনি আরো বলেছেন, ‘পরাজিত শক্তির দোসর ও চাটুকাররা এখনো কিছু আছে।’ দোসর ও চাটুকারদের সম্পর্কে এমন কথা কানে নতুন লাগল এবং আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। মনে পড়ল একটি সংস্কৃত তত্ত্ব কথা মশা নিয়ে, যা চাটুকারদের জন্য প্রযোজ্য। মশা উড়ে এসে কানে গুন গুন করে প্রশংসার গান করে আর সময়-সুযোগ পেলে অসংখ্য হুল বসিয়ে দেয়। দোসর ও চাটুকারদের বঙ্গবন্ধু এক কথায় বলেছিলেন ‘চাটার দল’। এতটুকু বলার পর যে প্রশান্তি মনকে ভরে তুলল, তাতে তিনি আর কিছু না বললেও চলত। কিন্তু তিনি বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর এমন এক উদ্ধৃতি দিলেন, যাতে আমার মনে হলো, কবি সুভাষ মুখোপধ্যায়ের কবিতার চয়নটি না বলে বঙ্গবন্ধুর এই তিনটি লাইন উদ্ধৃত করে কলামটা শুরু করলেই পারলাম।
পিতার উদ্ধৃতি দিয়ে কন্যা বলছেন, ‘জাতির পিতা বলতেন, ‘বাংলাদেশের মাটি উর্বর। এখানে চারা ফেলতেই যেমন গাছ হয়, তেমনি আগাছাও হয়। অনেক সময় আগাছা প্রকৃত গাছকেই খেয়ে ফেলে।’ জানা এই কালজয়ী উক্তিটি পড়ার পর মনে হলো, দেশের সবচেয়ে পুরনো ঐতিহ্যবাহী বড় সংগঠন ছাত্রলীগে ভালো ও মেধাবী ছাত্র বেশি, না খারাপ বেশি। নিঃসন্দেহে ভালো অগণিত অসংখ্য। তারা দলের কাছে স্বার্থের জন্য আসে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ও শত লক্ষ শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দলে নীরবে কাজ করে। দলকে তারা প্রাণের চাইতেও ভালোবাসে। এরা মঞ্চে ওঠে না, দুষ্কর্মও করে না কিন্তু দলের জন্য নিজ অবস্থান ও অবস্থা থেকে যতটুকু পারে, ঠিক ততটুকু করে। এদেরই কিন্তু আগাছা দলের প্রান্তস্থিত স্থানে ঠেলে দেয়। একটু খেয়াল করলেই এটা দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এবং শেখ হাসিনার কর্মসূচি বাস্তবায়নের উর্বর মাটিতে যে তরুণটি প্রকৃত গাছ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ছাত্রলীগে সক্রিয় হচ্ছে; সেই সোনার ছেলেটিই এক সময় আগাছা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে বাস্তব ক্ষেত্রে আগাছারা নিজেদের শক্তিকে ক্রমেই একচ্ছত্র করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।
এখানে অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক বছর আগে সোনালী ব্যাংকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের রিক্রুট হবে। লিখিত পরীক্ষায় পাস করে একটি ছেলে এসেছে আমার কাছে। সে কেঁদে কেঁদে আর পায়ে ধরতে এসে বলল, আমার চাকরির বয়স শেষ। ভালো ছাত্র ছিলাম। ছাত্রলীগ করতে এসে নানা অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়ি। তবে পাশ করে যাই। তারপর যুবলীগে স্থান করে নিতে পারিনি। ব্যর্থ হয়ে হতাশ ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বিধবা মায়ের কান্নায় মন ফিরল। পড়াশোনা করে পাশ করেছি লিখিত পরীক্ষায়। এখন আমাকে ভাইবার পর চাকরিটা করে দিন। ছেলেটির চাকরি হয় নেই। পরে এসে কেঁদেছে, আবারো পা ধরতে গেছে। জানি না প্রয়াত মুক্তযোদ্ধার সন্তানটি এখন কোথায়, কি করছে। এবারেও ব্যাংকের রিক্রুটিং হওয়ার সময়ে এমন ছেলে আরো অনেক পেয়েছি। অনেকেই মন্দ কাজে যুক্ত হওয়ায় এখন হতাশ। বাবা-মা পর্যন্ত ফোন করে বলে, ছেলে বিপথে যাচ্ছিল, এখন ভালো হতে চাইছে, একটা কিছু করুন। কি করা যাবে! নিয়ম কানুন ও নীতি-নৈতিকতার অবস্থান নিয়ে এদের জন্য কিছু করার কথা ভাবাও যায় না। যা ভাবি তা বলতে ভালোবাসি বলে বলি, আগাছা মুখের কথায় উঠবে না, আশু কিছু ব্যবস্থা নিলেও হবে না। অতীতে একটা স্বতঃসিদ্ধের মতো কথা ছিল যে, ভালো ছাত্ররা রাজনীতি যেমন করে, তেমনি ভালো ফল করে, তেমনি ভালো চাকরি পায়। আমরা ষাটের দশকে রাজনীতিতে যখন যুক্ত হই, তখন আঙুলে গুনতাম, রাজনীতি করা ছাত্র কতজন সিএসপি হয়েছেন, শিক্ষক-ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হয়েছেন। ছাত্র সংসদে নমিনেশন দেয়া হতো ভালো ছাত্রদের। ছাত্র সংগঠনগুলোতে ছিল মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ, কর্মিসভা ও রাজনৈতিক বই পড়া ছিল অভ্যাসের অঙ্গ। রাজনীতি করতে হলে টাকা লাগবে, এটা তখন আলোচনায় ছিল না। ১৯৭১-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নমিনেশনে বা জনগণের ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে কি টাকা প্রধান বিবেচনার মধ্যে ছিল? যদি থাকত তবে কনভেশন মুসলিম লীগের টাকাওয়ালা প্রার্থীদের পরাজিত করা সম্ভব হতো না। প্রসঙ্গত, বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এক বার রাজনৈতিক ক্লাস চালু করেছিলেন। যুক্ত হয়েছিলাম সেই কাজে। তখন ছাত্রনেতাদের রাজনীতি জানার আগ্রহ দেখেছি। ক্লাসের পর ঘরে গিয়ে তৈরি করে আসত পড়া। এখন ক্ষমতায় গিয়ে তা নেই কেন? জানি না।
একদিক থেকে এই কথাগুলো বললাম ঠিকই কিন্তু বিষয়টা সার্বিক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এনে দেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগে যেন যথাসম্ভব আগাছা না জন্মে সেই সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সঙ্গে রাখতে হবে অবিচ্ছিন্ন আগাছা পরিষ্কার করার পদ্ধতি। রাজনীতিতে যদি থাকে অর্থ ও অস্ত্রের দুর্বৃত্তায়ন, তবে আগাছার চেইন একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে আগাছা পরিষ্কার করা খুব একটা সোজা কাজ থাকে না। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তৃতা যদি না পড়তাম, তবে কলামটাতে এসব হয়তো লেখতাম না। লেখাটা অন্যদিকে প্রবাহিত হতো। যাই হোক, প্রসঙ্গত বলি রায়েরবাজারের ঘটনার পর দেখা গেল বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। বরং এতে দল ও সরকারের মধ্যে ব্যবধান বাড়ে। আর পর পর বন্দুক যুদ্ধের ঘটনার পর, যা মানুষ মনে করছিল একটা মেসেজ হিসেবে তৃণমূলে যাবে, ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো দুই একটি ঘটনার পর দেখা গেলো এটা মেসেজ হিসেবে থাকবে না। সংসদ সদস্য বদির মতো যত্যতত্র চড়-থাপ্পড়ইবা কমানো যাবে কিভাবে? পঁচাত্তরের পর জাসদ ও বাম বা পঁচাত্তরের কালরাতের পর তখনকার সেনাপ্রধানের ভূমিকা নিয়ে অযথা বিতর্কইবা ঠেকানো যাবে কিভাবে? প্রসঙ্গত, অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিতে ইতিহাস নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা এক কথা আর দায়িত্বশীল নেতাদের ঐক্য বা দলে থাকা কোনো দল বা ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে কথা তুলে কর্মী-সমর্থকদের বিভ্রান্ত করা ভিন্ন কথা। ফরিদপুর বা পঞ্চগড়ের সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি নিয়ে এবং প্রবীর সিকদারের গ্রেপ্তার নিয়ে যা হলো; তা হয়তো ফরিদপুরের বাড়ির মালিকের কথার পর চাপা পড়ে যাবে ঠিকই কিন্তু তাতে কথা কি কমবে? শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিজ স্বার্থের সঙ্গে ছাত্রদের যুক্ত করে যা করলেন, তাতে গ্রেপ্তার-বহিষ্কার কিংবা ভিসিকে সরানো যাই হোক না কেন, তাতে বলাবলি কি থামবে? রাজনীতিতে ক্ষত একবার হলে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সোজা নয়। বাসন্তীর মিথ্যা প্রচার এখন পর্যন্ত বহু মানুষ বিশ্বাস করে বসে আছে, আর চোখের সামনে দেখা ঘটনার দাগ কি এত সহজে মোছা সম্ভব হবে?
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এসব যদি হতে থাকে, তবে সরকারের বড় বড় কাজ কি জনগণকে দেখানো সম্ভব হবে? স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলে এত ভাঙা পুল-কালভার্ট মেরামত হলো, শত-লক্ষ শরণার্থীর পুনর্বাসন হলো এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ হলো। সেটা মানুষ মনে রাখছে না চাটার দলকে মনে রাখছে? এমনিতেই ক্ষমতায় থাকলে প্রত্যাশা থাকায় ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা বাড়ে, সমর্থন কমতেও দেখা যায়। সর্বোপরি রয়েছে, পবিত্র ধর্ম নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যাপ্রচার। চলছে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। এর মধ্যে যদি ভেতর পরিষ্কার না করা যায়, তবে বাইরের সৌন্দর্যকে নিঃসন্দেহে ঘর ঢেকে দেবে। স্বপ্নের সেতু পদ্মা নিয়ে কথা বলার চাইতে প্রবীর সিকদার নিয়ে ফরিদপুরের মানুষ কথা বলবে বেশি। বিদ্যুতের সাফল্যের চাইতে শাহজালালের ভিসি নিয়ে মাতামাতি চলবে। বঙ্গবন্ধু সেটেলাইটের খবর দাপট-দখলের খবর হটিয়ে বিদায় করেস দেবে। যতটুকু মনে হয় সরকারি কাজের চাইতেও মানুষ বিচার করে দলীয় কর্মকাণ্ডকেই বেশি। দলীয় নেতাকর্মীদের দেখেই মানুষ দলকে বিবেচনায় নেয়। এইটুকু যখন লেখা শেষ করেছি, তখন ঢাকার তৃণমূলের এক নেতা টেলিফোন করলেন। কথায় কথায় তিনি বললেন, এবারে শোক দিবসে যখন প্রচার হলো বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে কারো ছবি প্রচার করা যাবে না, তখন আরো বেশি করে বড় ছবি ও নাম দিয়ে পোস্টার ছাপানো হয়েছে। সময় আসলে বয়ে যাচ্ছে। পুঞ্জিভূত ক্ষোভের ভার খুব বেশি। বড় বড় সব অনভিপ্রেত ঘটনা পার হয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এক সময় ছোট ঘটনায় বড় কোনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। দেশবাসী বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মূলধারার রাজনীতির মানুষ এমনটা একেবারেই চায় না। চায় না পেন্ডুলামের মতো আশা-নিরাশায় দুলতে। চায় দল হয়ে উঠুক সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কাজের পরিপূরক।