দেশের জাহাজশিল্পে বিপ্লব এনেছে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি দেশে প্রথমবারের মতো পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে আশাতীত সাফল্যের পর এখন তৈরি করবে ছয়টি টর্পেডোসমৃদ্ধ অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ। একই সঙ্গে নদী ও সমুদ্র উপকূলে চলাচলের উপযোগী আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজের নির্মাণকাজ তো চলছেই। শুধু তাই নয়, কয়েক বছর আগের দেনার ভারে ন্যুব্জ খুলনা শিপইয়ার্ডের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটাও চমকে দেওয়ার মতো। ৫৭ বছরের পুরনো যে প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর আগেও লোকসানের ভারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, সে প্রতিষ্ঠানটিই গত পাঁচ অর্থবছরে মুনাফা করেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
খুলনা শহরের রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত খুলনা শিপইয়ার্ড এখন কর্মমুখর। ছোট-বড় নানা ধরনের নৌযান মেরামতের পাশাপাশি সেখানে এখন একই সঙ্গে চলছে চারটি কনটেইনারবাহী এবং দুটি কার্গো কাম কনটেইটারবাহী জাহাজ নির্মাণের কাজ। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য আরও দুটি অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ (লার্জ প্যাট্রল ক্রাফ্ট) তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ইতিহাসে এটিকে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে ধরা হচ্ছে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ যুদ্ধজাহাজের নির্মাণকাজের উদ্বোধন (কিললেইং) করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। জানা যায়, যুদ্ধজাহাজের মতোই বাংলাদেশে কনটেইনারবাহী জাহাজ নির্মাণের শুরুটাও খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে। ইতিমধ্যে নৌ-ফাউন্ডেশনের জন্য প্রায় ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি কনটেইনার জাহাজ তৈরি হচ্ছে; যার প্রতিটি ২০ ফুটের ১৪০টি কনটেইনার বহনে সক্ষম। প্রতিটি জাহাজ দৈর্ঘ্যে ৭৫ মিটার, প্রস্থে ১৩ দশমিক ৫ মিটার, পানি থেকে তলদেশের উচ্চতা সর্বোচ্চ ৪ মিটার। গতি ঘণ্টায় ১০ নটিক্যাল মাইল। জাহাজ দুটির নকশা অনুমোদন করেছে জাহাজের আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের নিপ্পন কাইজিকি কাইওকাই বা ক্লাস এনকে জাপান। একই সঙ্গে বিআইডব্লিউটিসির জন্য দুটো কনটেইনারবাহী জাহাজের নির্মাণ শুরু হয়েছে। এ দুটি জাহাজের প্রতিটি ২০ ফুটের ১৫৮টি কনটেইনার বহনে সক্ষম। দৈর্ঘ্যে ৭৬ মিটার, প্রস্থে ১৫ মিটার এবং সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১০ নটিক্যাল মাইল। নির্মিতব্য এ জাহাজ দুটির নকশা অনুমোদন করেছে নরওয়ের ব্যুরো ভেরিটাস বা ক্লাস বিভি নামের প্রতিষ্ঠান। এ প্রকল্পের অর্থমূল্য ৭৫ কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়া দুই বছর ধরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি হতে থাকা দুটি কার্গো জাহাজকে বর্তমানে কনটেইনার জাহাজে রূপান্তরের কাজ চলছে। এগুলো একই সঙ্গে কার্গো ও কনটেইনার জাহাজ হিসেবে কাজ করবে। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট ইউটিলিটি ভেসল নির্মাণ শেষে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের তিনটি পন্টুন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে এবং তিনটি ফায়ার ফ্লোটের নির্মাণ শেষের দিকে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য দুটি সাবমেরিন হ্যান্ডলিং টাগ নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর সৈয়দ ইরশাদ আহমেদ গতকাল সকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় এখানকার প্রতিটি জাহাজ তৈরি হয় ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির আন্ডারে। ইয়ার্ডের অবস্থান ও কাজের গুণগত মান দেখে ইতিমধ্যে কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, ক্রোয়েশিয়া, চীন ও তুরস্কের একাধিক শিপয়ার্ড জয়েন্টভেঞ্চারে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে।’ তিনি বলেন, বর্তমান ইয়ার্ডের সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যতের বড় ধরনের কার্যক্রমের কথা বিবেচনা করে ইতিমধ্যে মংলার জয়মনিগোলে জমি কেনা হয়েছে। ইয়ার্ডের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। লোকসান থেকে লাভে : মৃতপ্রায় শিল্পনগরী খুলনার অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে খুলনা শিপইয়ার্ডের উত্তরোত্তর সাফল্য ব্যতিক্রম। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ছিল প্রায় ৪২ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা প্রায় সাড়ে ৪৭ কোটিতে পৌঁছায়। গেল অর্থবছরে এ মুনাফা ৫৮ দশমিক ৮০ কোটি ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া সর্বশেষ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১৯ দশমিক ৬০ কোটি টাকা আয়কর দিয়ে খুলনা অঞ্চলের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি লাভ করে। এর আগের তিন অর্থবছরেও তারা এ স্বীকৃতি পেয়েছে। একই সঙ্গে গত ১৫ বছরে ইয়ার্ডের বার্ষিক টার্নওভার ১৭ দশমিক ৪৪ গুণ বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর সৈয়দ ইরশাদ আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখানে কর্মরত সবার ইতিবাচক মনোভাব, নিরলস প্রচেষ্টা এবং ব্যবস্থাপনার সততা, নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও অঙ্গীকারই আজকের এ সাফল্য।’ খুলনা শিপয়ার্ড সূত্রে জানা যায়, ৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা দেনাসহ ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর নৌবাহিনীর হাতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হস্তান্তর হয়। দীর্ঘ চড়াই-উতরাই শেষে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি ওই দেনা কাটিয়ে ওঠে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় সাফল্য রচিত হয় ২০১১ সালের ৫ মার্চ। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিপইয়ার্ডে এসে দেশের মাটিতে সর্বপ্রথম পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ (প্যাট্রল ক্রাফ্ট) নির্মাণকাজের উদ্বোধন (কিললেইং) করেছিলেন। সফল নির্মাণ শেষে ২০১৩ সালের মধ্যেই পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় খুলনা শিপইয়ার্ড এবার নির্মাণ করতে যাচ্ছে আরও বড় আকারের অত্যাধুনিক দুটি যুদ্ধজাহাজ (লার্জ প্যাট্রল ক্রাফ্ট)। আর্থিক ও কারিগরি দিক দিয়ে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এ যুদ্ধজাহাজের প্রতিটি দৈর্ঘ্যে ৬৪ দশমিক ২০ মিটার। প্রস্থে ৯ মিটার। আর পানি থেকে তলদেশের উচ্চতা ৪ মিটার; যার গতি ঘণ্টায় ২৫ নটিক্যাল মাইল। যুদ্ধজাহাজ দুটিতে থাকবে ছয়টি টর্পেডোসহ অসংখ্য যুগপোযোগী অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। কমডোর সৈয়দ ইরশাদ আহমেদ বলেন, প্রথমবারের মতো নৌবাহিনীর জন্য পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ সফলতাই শিপইয়ার্ডের অগ্রগতির চাকাকে গতিশীল করেছে। এটিই ছিল প্রতিষ্ঠানটির ঘুরে দাঁড়ানোর টার্নিং পয়েন্ট। জানা যায়, বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সবকিছুই এ প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে মেটানো হচ্ছে। খুলনা শিপইয়ার্ড ১৯৫৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭০৯টি বিভিন্ন প্রকারের জলযান নির্মাণ করেছে। আর মেরামত করেছে ২ হাজার ১৭৩টি জাহাজ। এর মধ্যে নৌবাহিনী দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন জাহাজ নির্মাণ করেছে ১১৬টি। আর মেরামত করা হয়েছে ৫২১টি জাহাজ। কমডোর সৈয়দ ইরশাদ আহমেদ জানান, ‘জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের বাইরে বর্তমানে এখানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জন্য বড় ময়লার কনটেইনার ও ট্রলি, চিনি ও পাটকলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, ফেরির পন্টুন ইত্যাদিও তৈরি হচ্ছে।’
সফল এক ব্যবস্থাপক : কমডোর সৈয়দ ইরশাদ আহমেদ সফল এক ব্যবস্থাপকের নাম। প্রায় ২০ মাস ধরে খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন শেষে গতকাল ৩১ আগস্ট চাকরি জীবনের ইতি টেনে অবসরকালীন ছুটিতে গেছেন। তিনি ১৯৭৯ সালে নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি একজন নেভাল আর্কিটেকচারও। চাকরি জীবনের শেষ কর্মদিবসে তিনি খুলনা শিপইয়ার্ড নিয়ে তার ভিশন সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির অদূর ভবিষ্যতে জাহাজ রপ্তানিকারকের খাতায় নাম লেখানো। ২ হাজার টন লাইটওয়েট জাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন এবং মংলার জয়মনিগোলে কেনা জায়গায় আরও বড় পরিসরে ইয়ার্ড তৈরি করে নির্মাণ সক্ষমতা বাড়ানো। এ তিনটি কাজের সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববাজারে শিপইয়ার্ড তার জায়গা করে নিতে পারবে। আশা করি, আগামীতে যারা এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আসবেন তারা আমার এ ভিশনের দিকে নজর রাখবেন।’
খুলনা শিপইয়ার্ডের শুরুর গল্প : ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (পিআইডিসি) খুলনা শিপইয়ার্ড নির্মাণের জন্য তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির মেসার্স স্টাকেন শন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করে। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৭ সালের ২৩ নভেম্বর থেকে উৎপাদনে যায়। সে সময় রূপসা নদীর প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ও গভীরতাকে বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ ৭০০ টন লাইটওয়েট বা ২ হাজার ৫০০ টন কার্গো ধারণসম্পন্ন জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের সুযোগ-সুবিধাসহ এটি নির্মিত হয়। উৎপাদনের শুরু থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা এবং পরে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জার্মান ও ব্রিটিশ ব্যবস্থাপনায় শিপইয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এরপর একই বছর ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (ইপিআইডিসি) প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। আর স্বাধীনতার পর এটি পরিচালনার দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (বিএসইসি)। প্রথম দিকে মোটামুটি সফলভাবে পরিচালিত হলেও আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এটি লোকসানের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে। দিন দিন লোকসানের লেখচিত্রটি ক্রমান্বয়ে নিুগামী হতে থাকে। নব্বই দশকে এসে লোকসানের ভারে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় তৎকালীন বিএনপি সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে রুগ্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি নৌবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয়। এখন প্রতিষ্ঠানটি জাহাজশিল্পে বিপ্লব এনে দিয়েছে!