দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারিকরণ কমিশনকে একীভূত করে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড ও শিল্প উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন করবে সরকার। নতুন এই কর্তৃপক্ষের সর্বময় ক্ষমতা থাকবে ‘গভর্নিং বডি’র হাতে, যার চেয়ারম্যান হবেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআই সভাপতিসহ বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিও থাকবেন গভর্নিং বডিতে। এই গভর্নিং বডি দেশি-বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের অধীনে একটি ‘আন্তমন্ত্রণালয় ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ থাকবে, যারা নিবন্ধিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সেবা দ্রুত নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারিকরণ কমিশন প্রতিষ্ঠান দুটিকে একীভূত করে এই কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য প্রণীত আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের বলেন, বেসরকারিকরণ কমিশন প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারছিল না। এ জন্য আরো দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে এই কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ ব্যবসাবান্ধব হবে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পরিচালনার জন্য ১৭ সদস্যের একটি পরিচালনা বোর্ড থাকবে। এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন প্রধানমন্ত্রী। ভাইস চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া একজন নির্বাহী পরিচালক থাকবেন।
বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারিকরণ কমিশন একীভূতকরণের উদ্দেশ্যে খসড়া আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ। সম্প্রতি তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন সমস্যার কারণে বিনিয়োগে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না। এসব সমস্যা দূর করে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য ও সেবা দ্রুত নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারিকরণ কমিশনকে একীভূত করতে সরকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা শিগগিরই বাস্তবায়ন হবে। এটি হলে বিনিয়োগকারীরা এক ছাদের নিচেই সব ধরনের তথ্য ও সেবা পাবে।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের সময়ই গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি, পয়ঃপ্রণালি ও সব টেলিযোগাযোগ সংযোগ দেওয়ার সময়সীমা লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে। এ ছাড়া আমদানি করা যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের ক্ষেত্রে শুল্ক কর্তৃপক্ষের ছাড়করণ, পরিবেশ দূষণসম্পর্কিত ছাড়পত্র এবং শিল্প স্থাপন ত্বরান্বিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার সময়সীমা নির্ধারণ করে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেবে। নিবন্ধিত শিল্প বিনিয়োগের জন্য বৈদেশিক ঋণ, সরবরাহকারী ঋণ (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) ও বিলম্বিত ঋণের পরিমাণ ও শর্তও ঠিক করে দেবে কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শিল্প স্থাপনে সরকার বেপজা, বেজা, বিসিক ছাড়া অন্য যেকোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণাধীন শিল্প এলাকায় জমি বরাদ্দ দিতে পারবে।
এতে আরো বলা হয়েছে, কোনো শিল্প মালিক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে কোনো অসুবিধা হলে তা দূর করতে বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারবে। কর্তৃপক্ষ আবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিনিয়োগকারীর সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেবে। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ বা অপারগ হলে কর্তৃপক্ষ তা পর্যালোচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত দেবে, যা মেনে চলতে বিনিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাধ্য থাকবে। তবে অনুমোদন-সংক্রান্ত কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে শিল্প প্রকল্পটির অনুমোদন বাতিল করতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এই কর্তৃপক্ষের সর্বময় সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে কাজ করবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত গভর্নিং বডি। এতে ভাইস চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া শিল্পমন্ত্রী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী গভর্নিং বডির সদস্য থাকবেন। কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এবং সরকার মনোনীত আরো দুটি বিশেষায়িত চেম্বারের দুজন প্রতিনিধি থাকবেন, যাঁদের একজন নারী। এই গভর্নিং বডি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেবে। এমনকি সরকারের অব্যবহৃত জমি বরাদ্দ দেওয়া, অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা, এলাকাভিত্তিক শিল্প স্থাপনে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ, দেশি-বিদেশি সব শিল্প প্রকল্প অনুমোদন ও নিবন্ধীকরণ দেওয়াসহ বেসরকারি খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। সর্বোচ্চ ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি শিল্প ও কলকারখানা বা তার সম্পত্তি গভর্নিং বডি এককভাবে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। তবে এর চেয়ে বেশি মূল্যের সম্পদ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত সরকারের ‘অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’তে অনুমোদন হতে হবে।
খসড়া আইনের ১১(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হইলে এই আইনের অধীন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত শিল্প বলিয়া গণ্য হইবে এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত শিল্পের ক্ষেত্রে যে সকল সুযোগ-সুবিধার বিধান করা হইবে উক্ত শিল্পের ক্ষেত্রেও উহার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সকল সুযোগ-সুবিধার বিধান করা যাইবে।’
বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারিকরণ কমিশন একীভূত হয়ে কর্তৃপক্ষ গঠন হলে আমদানি স্বত্ব নির্ধারণের ক্ষমতাও থাকবে তাদের হাতে। খসড়া আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বেসরকারি ইপিজেড ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার আওতাধীন শিল্প এবং বস্ত্র শিল্প ব্যতীত বেসরকারি খাতে স্থাপিত কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল ও মোড়ক উপকরণ আমদানি স্বত্বের প্রয়োজন হইলে প্রতিষ্ঠানটি কর্তৃপক্ষের কাছে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও ফরমে আবেদন করবে।’
বিদম্যান আইনে বিনিয়োগ বোর্ড একজন ব্যবসায়ীকে শুধু প্রকল্পের নিবন্ধন দিতে পারে। ব্যবসায়ীদের জমি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বিনিয়োগ বোর্ডের হাতে। তা ছাড়া বোর্ডের নিজস্ব কোনো প্লট বা জমি নেই। অন্যদিকে শিল্প, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে অব্যবহৃত পড়ে থাকা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার একর সরকারি জমি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বেসরকারিকরণ কমিশনকে। কিন্তু মন্ত্রীদের তীব্র বিরোধিতার কারণে গত পাঁচ বছরে এক একর জমিও বেসরকারি খাতে ছাড়তে পারেনি কমিশন। একদিকে জমির জন্য হাহাকার, অন্যদিকে সরকারি জমি অব্যবহৃত পড়ে থাকা-এমন বাস্তবতায় এ দুটি সংস্থাকে একীভূত করে বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া আইনে সরকারের বিভিন্ন কলকারখানার অব্যবহৃত জমি বেসরকারি খাতে হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে সরকার তার জমি নির্দিষ্ট ফিসের বিনিময়ে বেসরকারি খাতে শিল্প স্থাপনে হস্তান্তর করবে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তা পরিচালনায় ব্যর্থ হলে সরকারের অনুকূলে প্রত্যর্পণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার বিধিমোতাবেক ওই প্রতিষ্ঠানের মূল্য পরিশোধ করবে। সামগ্রিকভাবে সরকারের কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের পুরোটা, অংশবিশেষ, জমি বা মেশিনারি বরাদ্দ দেওয়া যাবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অংশীদারির ভিত্তিতে এসব কারখানা ও মেশিনারি বরাদ্দ নিতে পারবে এবং লিজে জমি গ্রহণ করতে পারবে। হস্তান্তরকালে কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত যাতে না হন, সে জন্যও আইনে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা হয়েছে। তবে কোনো শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান হস্তান্তরের পর বেসরকারি খাত শর্ত বরখেলাপ করলে হস্তান্তর ও লিজ দলিল অনুসারে সরকার বা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান পুনর্দখল করে দলিল বাতিল করতে পারবে।
এই আইন বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রহিত হয়ে যাবে ‘বিনিয়োগ বোর্ড আইন ১৯৮৯’ এবং ‘বেসরকারিকরণ আইন ২০০০’। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রতিষ্ঠান দুটিও। খসড়া আইনের ৩৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিলুপ্ত বিনিয়োগ বোর্ড এবং বেসরকারিকরণ কমিশনের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও শিল্প উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’র নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী বলে গণ্য হবেন।’ বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারিকরণ কমিশন একীভূত হলে এটি হবে দেশের একীভূত হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা। এর আগে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি শিল্প ব্যাংক এবং শিল্প ঋণ সংস্থাকে একত্রিত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গঠন করা হয়।