দেশে বর্তমান দারিদ্র্যের হার (দৈনিক ন্যূনতম ২ মার্কিন ডলার আয় সীমায়) ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১২ সালের মধ্যে সরকার এটিকে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ নামিয়ে আনতে চায়। বর্তমানে দেশে অতি দারিদ্র্যের হার (দৈনিক ন্যূনতম ১ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার আয় সীমায়) ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এটিকে সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ নামিয়ে আনতে আশাবাদী। ২০২০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৮৭ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ সময়ে অবশ্য নতুন করে ১ কোটি ২৫ লক্ষ মানুষ নতুন করে শ্রমশক্তিতে যুক্ত হবে।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যর হার ছিলো মোট জনগোষ্ঠীর ৬৩ শতাংশ। তার মধ্যে শহরে ছিলো ৬৮ শতাংশ আর গ্রামে ৬২ শতাংশ। ১৯৯৪ সালে এ সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে। তার মধ্যে শহরে ৪৪ শতাংশ আর গ্রামে ৫৭ শতাংশ। ২০০৪ সালে এটি দাঁড়ায় মোট জনগোষ্ঠীর ৪২ শতাংশে। তার মধ্যে শহরে দারিদ্র্য ৩০ শতাংশ আর গ্রামে ৪৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য পীড়িত লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৭ শতাংশে। তার মধ্যে গ্রামে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ আর শহরে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত ২০ বছরে দারিদ্র্য হ্রাসের পর্যালোচনায় দেখা যায় গ্রামের চাইতে শহরে দারিদ্র্য হ্রাসের হার বেশি। তার অর্থ শহরে বস্তিবাসী বা ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পুঁজির সংবর্ধনের হার বেশি। গ্রামে যদিও ইদানিংকালে প্রবাসী রেমিটেন্স বাড়ছে; এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তথাপিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা, অপর্যাপ্ত শিক্ষার প্রসার এবং বিদ্যুত্ ও জ্বালানির অভাবে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়াকে খুব টেকসই করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস প্রক্রিয়া বেশ সচল হলেও এমনকি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বা দারিদ্র্য হ্রাসের হার জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২ বছর আগেই পূরণ হলেও দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়াকে আরও সচল করা যাচ্ছে না। তার কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব, দুর্বল অবকাঠামো, বাজেট বরাদ্দের গুণগত ব্যবহারে অসক্ষমতা, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, জন প্রশাসনের অদক্ষতা এবং সুশাসনের অভাবকেই দায়ী করছেন অনেকে।
অন্যদিকে পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের ৪০ শতাংশের বেশি এখন কোটিপতিদের দখলে। ৫০ ভাগ লাখপতি আর ১০ ভাগ আমানত রয়েছে লাখ টাকার নিচের অ্যাকাউন্টগুলোয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কাছে ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে। অনেক ধনী বা খুব গরিবের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট ফারাক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালের মার্চে দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ছিল ১২ হাজার ৯১৭টি। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৬৮৭টিতে। সে হিসাবে গেল ৬ বছরে দেশে ব্যক্তিপর্যায়েই কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার ৭৭০টি। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ২১৫ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০০৯ সালের মার্চে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলে ব্যাংকে কোটি টাকার ঊর্ধ্বে অ্যাকাউন্ট ছিল ১৯ হাজার ৬৩৬টি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৭২৭টিতে। সে হিসাবে ৬ বছরে দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় মিলে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৭৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি অ্যাকাউন্টধারী ছিলো মাত্র ৫ জন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ৪৭-এ পৌঁছে, যা ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯৮ জন। তখন তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ। এরপর ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩-এ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ এবং ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২। এরপর অক্টোবর ২০০১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল ৮ হাজার ৮৮৭ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরে বেড়েছিল ৫ হাজার ১১৪।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাভাবিক কারণেই অনেক উচ্চাশা আর আকাঙ্ক্ষা নিয়েই যাত্রা হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর উন্নয়ন পরিকল্পনার। তবে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে সামপ্রতিক দশকগুলোয় সামাজিক অসমতা ও বৈষম্য যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে পাকিস্তান আমলের অর্থনীতিরই যেন পুনরুজ্জীবন ঘটছে। সমাজের বিরাট এক অংশ এখনো ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঘুমাতে যায়। মানসম্মত শিক্ষা, চিকিত্সা ও পরিবেশসম্মত আবাসন সুবিধা এখনো সাধারণের আয়ত্তের বাইরে। সমাজের ৭৫ শতাংশ মানুষের জীবনে অসচ্ছলতা ও অস্বাচ্ছন্দ্যের প্রমাণ মিলছে। জীবনমুখী ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্নয়নতত্ত্ব দেখার প্রয়োজন যেন অনেকটাই হারিয়ে গেছে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায়। দেশের উন্নয়নতত্ত্বের প্রধান ত্রুটি হচ্ছে, এখানে মনোযোগ দেয়া হয়েছে জাতীয় আয় বৃদ্ধির উপর, বণ্টনব্যবস্থা নিয়ে তেমন ভাবা হয়নি। ফলে জাতীয় আয় বাড়ার প্রধান সুবিধাভোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমিত কিছু মানুষ, আর বিরাট অংশের সম্ভাবনা এখনো রয়েছে অবহেলিত।
আমাদের উন্নয়ন সাফল্যে দারিদ্র্যর হার কমার কথা বলা হলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সমাজের একটি অংশ বড় অঙ্কের কালো টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। রাজনৈতিক আনুকূল্যে কিছু লোক রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাওয়ায় সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, সত্যিকারের উদ্যোগী লোকেরা হতদমিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ওয়েলফেয়ার মনিটরিং সার্ভে অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশের হাতেই সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণি মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। এর বাইরে ৭৫ শতাংশ মানুষই উন্নয়নের বড় ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কোনোভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে দিন পার করছে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। আর দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার। দারিদ্র্যর কশাঘাতে জর্জরিতের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ খাদ্যচাহিদা মেটাতে হয়ে পড়ছে ঋণগ্রস্ত। সমাজের এ অংশটি ক্রমেই ঋণভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
১৯৭২ সালের প্রাক্কলন ঠিক হলে অর্থনীতির প্রধান মানদণ্ডগুলোর নিরিখে আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতি আজকের মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে অনেকগুণ ছাড়িয়ে যেত এবং সেই সঙ্গে প্রাগ্রসর উন্নয়ন দর্শনের বৈশিষ্ট্যের কারণেই আর্থ-সামাজিক শ্রেণি কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটে শ্রেণি-বৈষম্য হ্রাস পেয়ে সমাজ অনেকটা সমতাভিমুখী হতো যা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় এবং আজকের বাংলাদেশে তো চরম বৈষম্যমূলক।
পরিকল্পনা অনুসারে সবকিছু ঠিক থাকলে আজকের বাংলাদেশে মোট দেশজ উত্পাদন (জিডিপি) হতো ৪২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার যা একই সময়ের মালয়েশিয়ায় ১৫ হাজার ৪২৬ কোটি ডলার অর্থাত্ মালয়েশিয়ার তুলনায় (২০ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বা ১৫ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা) ২.৭৩ গুণ বেশি এবং যা আজকের বাংলাদেশের তুলনায় ২.০৫ গুণ বেশি। আজকের বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি মালয়েশিয়াকে অতিক্রম করত। আমাদের মাথাপিছু জিডিপি হতো ৬ হাজার ৬১ ডলার যা মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৩৪৫ ডলার। মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) ক্ষেত্রেও আজকের বাংলাদেশ মালয়েশিয়াকে ২.৮গুণ অতিক্রম করতো। আজকের বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয় হতো ৪২ হাজার ৫১৪ কোটি ডলার বিপরীতে এখন মালয়েশিয়ার মোট জাতীয় আয় ১৫ হাজার ৫ কোটি ডলার। আজকের বাংলাদেশে মাথাপিছু জাতীয় আয় হতো ৫ হাজার ৫৯৮ ডলার যা মালয়েশিয়ায় একই সময়ে ৫ হাজার ১৯৯ ডলার।
তুলনীয় পিপিপি ডলারে মাথাপিছু প্রকৃত জাতীয় আয়কে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপনের অপেক্ষাকৃত শ্রেয় মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। উন্নততর ব্যবস্থাপনায় আজকের বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত জাতীয় আয় (পিপিপি ডলারে) এখন হতো ১৪ হাজার ১০০ ডলার যা মালয়েশিয়ায় ১৩ হাজার ৮২২ ডলার, অথচ আজকের বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত জাতীয় আয় মাত্র ১ হাজার ৮৯০ ডলার (প্রাক্কলনের তুলনায় প্রায় ৭.৫গুণ কম)। আরেকটি সত্য কথা হচ্ছে বাংলাদেশের ধনী-দরিদ্র সবাই বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং যানজটের শিকার। যদিও দরিদ্রদের জন্য অভিঘাতটি আরও বেশি তবে সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার মান অনেক নিচু। সবাই যেন হাঁফিয়ে উঠছে। যারা পারছে তারা বিভিন্নভাবে দেশ ত্যাগ করছে। অন্যরা যেন অনিচ্ছায় দেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। একজন ব্যক্তি বা পরিবারের শিক্ষা ব্যয় বা স্বাস্থ্য-সেবার জন্য ব্যয় অনেক বাড়লেও ভালো শিক্ষা বা স্বাস্থ্য-সেবা হয়ে যাচ্ছে সোনার হরিণের মতো দুষ্প্রাপ্য। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কেবল মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যুতসই পরিকল্পনা গ্রহণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুণগত পরিবর্তন।
আমরা কিছুতেই সম্পদ সৃষ্টি প্রক্রিয়া বা জাতীয় পুঁজি গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকে শ্লথ বা বাধাগ্রস্ত করতে চাই না। আমরা এটাও জানি যে ব্যক্তিখাতই হবে অর্থনীতির মূলচালিকা শক্তি। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চাই ব্যক্তিখাতের বিকাশের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, কমবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। অন্যদিকে আমরা চাই রাজনৈতিক হানাহানি, দুর্নীতি কিংবা বিচারহীনতার কারণে সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্ট যেন না বাড়ে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অভাবে কৃষকের মেয়েটি, পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকটির জীবনে যেন না নেমে আসে অমানিশা। উদ্যমী কৃষক যেন তার উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রায়। গ্রামের মানুষ যেনো সরকারি হাসপাতালে ন্যূনতম চিকিত্সা-সেবা পায়, আর অজপাড়াগাঁয়ের ছোটো পান-সুপারি বিক্রেতার ছেলেটিও যেন তার মেধাগুণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজি সংবর্ধন এবং সঞ্চালনের পথও যেন থাকে অবারিত।