ধনে ও মানে এখন আমাদের বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। যার মর্যাদাকর স্বীকৃতি এখন খোদ এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি অপবাদ দেয়া মানুষরাই অকপটে দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার পিতৃদেশ অর্থাৎ বাবার দেশ আফ্রিকার কেনিয়াতে ব্যক্তিগত ঢঙয়ে এক সরকারি সফর করেছেন। সেখানেই তিনি বিশ্বে বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন ও উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে বক্তব্য রাখার সময় আমাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে অন্যতম মডেল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সে সঙ্গে অন্যান্য অনেক সফল কাজের সঙ্গে বিশেষত বাংলাদেশের ডিজিটাল ব্যবস্থার অভূত ও অভাবনীয় উন্নয়নকে যুগান্তকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা কিনা কেনিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। একই মন্তব্য অবশ্য কম্পিউটার প্রযুক্তিকে বিশ্বের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে দিয়ে যিনি নিজেও একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, সেই তথ্যপ্রযুক্তির মহামানব বিশ্বের একনম্বর ধনী ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত মাইক্রোসফটের স্বত্বাধিকারী বিল গেটসও বলেছেন।
কেন, কিভাবে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে এই ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করল সেটি খোঁজার জন্য একটু পেছনে যেতে হবে। আমরা একটু অতীতের কথা স্মরণ করলেই মনে পড়বে, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র উপক‚লে অবস্থিত পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পাশ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিকে গ্লোবালাইজ করার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবল সংস্থাপন হওয়ার সময় ওই অবকাঠমোতে আমাদের বাংলাদেশকে বিনামূল্যে সংযুক্ত করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু তখন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর আমাদের দেশীয় বিশেষজ্ঞ কর্তৃক সাবমেরিন ক্যাবলের সুযোগ-সুবিধা এবং এর সুফল সম্পর্কে বিষয়টির সপক্ষে জোরালো মতামত দেয়ার পরও দেশের তথ্য পাচার হয়ে যাবে এরকম একটি আত্মঘাতী ভীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে সেসময় তাতে যুক্ত করা হয়নি। অথচ একটি ভুলের কারণে এতদিন পরেও এখনো মিলিয়ন-বিলিয়ন অর্থ খরচ করেও আমরা সে লক্ষ্যে পুরোপুরি পৌঁছাতে পারিনি যা আগে খুব সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যেত। শুধুমাত্র একটি সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য এমনটি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন। সে সময় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে এতদিনে দেশ ডিজিটালের পথে আরো অনেকদূর এগিয়ে যেত এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অতঃপর ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকারের আমলে মোবাইল ফোনের বিস্তারকে উন্নয়নের একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে এ খাতে মনোপলিকে বাদ দিয়ে এ খাতকে প্রণোদনা প্রদান শুরু হয় এবং তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তারপর ২০০১ পরবর্তীতে এ সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে তাদের এখাতে গৃহীত প্রকল্পগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি। যার ফলে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে অন্যান্য অনেক চমকপ্রদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে তাদের মেয়াদকালেই দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল। আর তখন থেকেই এর নেপথ্য নায়ক হিসেবে যিনি কাজ করছিলেন তিনি হলেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, বিশিষ্ট কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানী, জননেত্রী শেখ হাসিনার তনয় ও সুযোগ্য উত্তরসূরি সজীব ওয়াজেদ জয়। তরুণ অভিজ্ঞ ও স্বেচ্ছায় অবৈতনিকভাবে নিবেদিতপ্রাণ এ প্রযুক্তিবিদকে তাই দেশের প্রভূত উন্নয়নের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন। তিনি এ খাতে নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে আজকের এ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন।
দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে বলেই না আজ বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিবেচনায় নিম্ন আয়ের দেশের কাতার থেকে টেনে তুলে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দিয়েছে। এ স্বীকৃতিটুকু যে তারা খুব খুশি মনে দিয়েছে তা কিন্তু নয়, কারণ তারাই পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হতে পারে এ আশঙ্কায় সেখানে ঋণচুক্তি করেও সেখান থেকে সরে এসে বাংলাদেশকে অপমান করতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ইনি। অথচ বাংলাদেশ তার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে পেরেছে এবং এটাও আশা যে, পূর্ব নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্থাৎ ২০২১ সালের আগেই আবার মধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হবে, অর্থনীতিবিদদের তাই ধারণা। সেখানে দেখা যায় বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে বলেই নিজস্ব অর্থায়নেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১৮ সালের মধ্যেই সেই আলোচিত পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্প শেষ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা যাচ্ছে। এসব উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে প্রাপ্ত সুফলের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। আজ সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে ডিজিটাল ডিভাইস ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিস্তৃত এবং অনেকাংশে বাধ্যতামূলকও বটে।
অনেক দুর্বোধ্য বিষয় এখন অতি সহজেই ডিজিটাল পদ্ধতির কল্যাণে পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেক জেলায়, উপজেলায় এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এখন ডিজিটাল সেবা বিস্তৃত যা একেবারে কৃষকের দোরগোড়ায়। এখন দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে নামেমাত্র খরচে দেশ-বিদেশে সহজেই যে কেউ যে কোনো সময় যোগাযোগ করতে পারছে। আজকে দেশের উন্নতির যে স্বীকৃতিগুলো আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে পাচ্ছি সেগুলো উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, এমপিরা এবং তদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তখন তাদের সেই বক্তব্যকে বিশ্বাস না করে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং মিথ্যাবাদ হিসেবে উপহাস ও কটাক্ষ করা হয়েছে। কিন্তু এখন নিন্দুকদের এ কথাগুলো মিথ্যায় প্রতিভাত হয়েছে এবং সত্যই জয়ী হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এ খাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি তারুণ্যোদ্দীপ্ত টিম সবসময় দেশের কল্যাণ ভাবনায় কাজ করছেন যার কেন্দ্রে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তার সঙ্গে রয়েছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জোনায়েদ আহমেদ পলক, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট তারানা হালিমসহ এ খাতে দেশের বরেণ্য সব ব্যক্তি। সম্প্রতি শ্রমনির্ভর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে জ্ঞানভিত্তিক দেশ গঠনের লক্ষ্যে ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরো বাড়িয়ে এর মূল্যহ্রাসসহ আরো অনেক গঠনমূলক কাজের জন্য সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে পুনরায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। দেশের আইটি সেক্টরকে আরো গতিশীল এবং একে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য ঢাকার অদূরে অতিদ্রুত একটি আইটি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে দেশের প্রায় ৬০ হাজার তরুণ প্রযুক্তিবিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বিভাগীয় শহরে এমনকি আরো নিচের দিকেও তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনামাফিক প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে এ খাতকে আরো যুগোপযোগী করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখন ৫ম ডোমেইনের কথাও ভাবা হচ্ছে। সর্বোপরি আজ যে কোনো ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি যে উজ্জ্বল হয়েছে তার বড় প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক বারাক ওবামা ও বিল গেটসের বক্তব্য থেকে। আর এটাই জাতি হিসেবে আমাদের বড়প্রাপ্তি। এখন দেশপ্রেমিক হিসেবে আমাদের সবার কাজ হলো বহু ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত এ সাফল্য শুধু ধরে রাখলেই চলবে না, আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো উচ্চাকাক্সক্ষী ও উচ্চাভিলাষী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ী হতে হবে।
ড. মো. হুমায়ুন কবীর : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।