ব্যাংক ব্যবস্থায় এবার খেলাপি ঋণ কমেছে। গত মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৪ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত জুন শেষে তা কমে ৫২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ১৪২ কোটি টাকা কমে গেছে। ঋণ আদায় বেড়ে যাওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ তিন মাসে খেলাপি ঋণ ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এটা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক। আরো বেশি পরিমাণে ঋণ আদায় করা গেলে খেলাপি সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব বলে অনেকেই মনে করছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৫৩ দশমিক ৬০ শতাংশ রাষ্ট্র মালিকানাধীন পাঁচটি ব্যাংকের বিতরণ করা। আর ৬৭ দশমিক ৪০ শতাংশ খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে ১০টি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ থেকে।
খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ার ব্যাপারে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী বলেন, গত বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে ব্যাংকগুলোকে সতর্কভাবে হাঁটতে হয়েছে। এ সময় উচ্চ সুদের আমানত ফেরত দেয়া হয়, পরিচালন ব্যয়ও কমানো হয়। অন্যদিকে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ আদায়ের দিকে ব্যাংকগুলো বাড়তি গুরুত্ব দেয়ায় খেলাপি ঋণ কমেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, এখন ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এটা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক। ঋণ আদায় কার্যক্রম আরো বাড়াতে পারলে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণ অনেক বেশি। এ জন্য এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি। খেলাপি ঋণ আদায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বদা তাদের তাগিদ দিচ্ছে। সম্প্রতি এসব ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানদের নিয়ে বৈঠকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্যানুযায়ী, জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হওয়া ৫২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত মার্চ পযন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। ওই ঋণের ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিল খেলাপি। এর আগে ব্যাপক পুনঃতফসিলের সুযোগে গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কমেছিল। গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা কমে ৫০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। যা ছিল মোট ঋণের ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। জানা গেছে, ২০১৪ সালের শুরুতে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ মাত্র ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট (এককালীন জমা) দিয়ে পুনঃতফসিল করার সুবিধা দেয়। এই সুবিধায় ১২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণের একটি অংশ আবার খেলাপিতে পরিণত হওয়ায় মার্চে তা আবার বেড়ে যায়। গত প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর আদায় বাড়ার ফলে তা আবার কমেছে বলে জানা গেছে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হোসেন খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণ কমে আসলে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও কমে আসবে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমে না আসার কারণে নতুন কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুৎসংযোগও পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান গ্যাস-বিদ্যুৎসংযোগ পাওয়ার আশ্বাসে নতুন কারখানা স্থাপন করে সংযোগ পায়নি। ফলে উৎপাদনে যেতে পারেনি। যে কারণে তাদের অনেকে খেলাপি হয়ে পড়েছে। আবার চালু প্রতিষ্ঠানগুলোও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাচ্ছে না। যে কারণে তাদের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের বকেয়া ঋণের পরিমাণ (কর্মচারী ঋণ ছাড়া) ১ লাখ ৪ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। এ সময়ে সোনালী ব্যাংক বার্ষিক ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে মাত্র ৩২০ কোটি ২১ লাখ টাকা বা ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছিল ৪২৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বা ২০ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত জুন শেষ অগ্রণী ব্যাংক বার্ষিক ৯০০ কোটি টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে মাত্র ১৮৩ কোটি ৪ লাখ টাকা বা ২০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৩৪২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছিল ২৮৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বছরের ৬ মাস শেষে রুপালী ব্যাংক ৩০ কোটি ৩০ লাখ টাকা বা ১০ দশমিক ৮২ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করেছে। অন্যদিকে বিতর্কিত বেসিক ব্যাংক আলোচ্য সময়ে ১৬৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বা ২১ দশমিক ০৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করেছে। এ বছর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৮০০ কোটি টাকা। বছরের ৬ মাসে বেসিক ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরে ব্যাংকটি ৬৩০ কোটি টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছিল মাত্র ৩৬ কোটি ৫ লাখ টাকা বা ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর বিশেষায়িত বিডিবিএল ৯০ কোটি টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে মাত্র ১০ কোটি ৩ লাখ টাকা বা ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৫৪০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটি ৭০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছিল ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বা ১৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।