এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের গৌরবময় অবস্থান

ড. শামসুল আলম সদস্য (সিনিয়র সচিব) সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন

বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের পথপরিক্রমায় অমিত সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠছে, ঠিক সে সময় বিশ্বব্যাপী নতুন সহস্রাব্দে পৃথিবীর সব দেশের, বিশেষত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করতে জাতিসংঘ তখন কতগুলো লক্ষ্য নির্ধারণের চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। বাংলাদেশও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘের এ উদ্যোগে একাত্ম হয়। বিশ্বনেতাদের যৌথ উদ্যোগের ফলে একুশ শতকের সূচনালগ্নে, ২০০০ সালে মানবজাতি অবলোকন করে এক বিরল বৈশ্বিক ঐকতান— ‘সহস্রাব্দ ঘোষণা’।

কালের পরিক্রমায় বিশ্ববাসী এখন ২০১৫ সাল অতিবাহিত করছে। এমডিজি অর্জনে অন্যতম সফল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ-যাবত্কালের অর্জন ও অপূর্ণ থেকে যাওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যালোচনা করছে। সহস্রাব্দ ঘোষণার মতো এ সময়ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী বিশ্বনেতাদের অন্যতম, যিনি সহস্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণায় উপস্থিত ছিলেন এবং এমডিজির সফল সমাপনেও জাতিসংঘে এবারো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। এরই মধ্যে সরকারের বিগত সাত বছরের নানামুখী প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ; যেমন— মাথাগুনতি দারিদ্র্য ও দারিদ্র্যের গভীরতা হ্রাস, অপুষ্টিজনিত স্বল্প ওজনের শিশুর সংখ্যা কমানো, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা আনা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং তাদের জন্য পতঙ্গ-নিরোধক মশারির ব্যবস্থা, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, এইচআইভি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় ও নিরাময়। বর্তমান সরকারের আমলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এমডিজি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। অধিকাংশ সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ, বিশেষত ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। উপমহাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে, বিশেষত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সফলতার বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উল্লেখ করেছেন। এ প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আটটি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের বিপরীতে বাংলাদেশের এ-যাবত্কালের অর্জনের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক—

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ১: চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূলকরণ

বাংলাদেশ ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূলে’ প্রশংসনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। কয়েক বছর যাবত্ বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়মিতভাবেই ৬ শতাংশের উপরে রয়েছে, যা দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কারণে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭, ২০১০ সালে তা ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। নব্বইয়ের দশক অপেক্ষা গত দশকে দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল দ্রুততর। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০০-২০১০ মেয়াদে গড়ে প্রতি বছর দারিদ্র্য কমেছে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে; যদিও এমডিজি অর্জনে একই সময়ের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রতি বছর গড়ে ১ দশমিক ২০ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাস। যে হারে দারিদ্র্য কমেছে, তাতে প্রাক্কলিত হিসাবে ২০১২ সালেই বাংলাদেশ ভিত্তি বছরের তুলনায় দারিদ্র্য হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সর্বশেষ অর্থমিতিক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মাথাগুনতি দারিদ্র্যের হার হলো ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশের সফলতা বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশকে ২০১৩ সালে ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করে এবং বাংলাদেশের ক্ষুধা নির্মূলের প্রচেষ্টাকে বিশেষ স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে ২০১০ সালেই দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের গভীরতা কমানো শীর্ষক অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হয়েছে এবং ২০১৫ সালের চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশের বিপরীতে এ হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য নিরসনে সাফল্যের পাশাপাশি ক্ষুধা নিরসনেও বাংলাদেশ ভালো অগ্রগতি সাধন করেছে। ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জনমিতিক ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৪তে দেখা যায় যে, পাঁচ বছরের কম বয়সী বিকাশ রুদ্ধ শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়ে ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ২: সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অবৈতনিক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ শীর্ষক বৈশ্বিক সনদে বাংলাদেশ অন্যতম অনুস্বাক্ষরকারী। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও সময়োপযোগী কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দৃশ্যমান সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নিট ভর্তি হার ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছেলে ৯৬ দশমিক ৬ ও মেয়ে ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার ১৯৯১ সালে ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৮১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষায় ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার, ঝরে পড়ার হার কমানো, শিক্ষাচক্র সমাপ্তির ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন এবং প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলকে জাতীয়করণ করা হয়। শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিশুকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি) ও জুনিয়র শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (জেএসসি) চালুকরণ, সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণ ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফলাফল ঘোষণা, শিক্ষা ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি। সবার জন্য শিক্ষা— এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ১ ও ২ প্রণয়ন করেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ১৫-২৪ বছর বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশে উপনীত হয়েছে; পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ৭৪ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৭৭ শতাংশ। ১৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার শিক্ষার হার ১৯৯০ সালের ৩৭ দশমিক ২ থেকে বেড়ে ৬১ দশমিক শূন্য শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ৩: জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন

বাংলাদেশ এরই মধ্যে ‘জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক লক্ষ্যটি অর্জন করেছে। অর্থাত্ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা বিস্তারে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ‘UNESCO Peace Tree Award’-এ ভূষিত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে ও মেয়ের অনুপাত ১ দশমিক শূন্য ৩, অর্থাত্ প্রতি ১০০ ছেলের বিপরীতে ১০৩ জন মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ১৯৯০ সালে এ অনুপাত ছিল শূন্য দশমিক ৮৩। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ের অনুপাত ১৯৯০ সালের শূন্য দশমিক ৫২ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ১৪। অন্যদিকে এ সময়কালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ অনুপাত শূন্য দশমিক ৩৭ থেকে শূন্য দশমিক ৬৭ হয়েছে। এই ইতিবাচক উন্নয়নের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি যেমন— গ্রামীণ অঞ্চলে উপবৃত্তি ও মেয়েদের জন্য বিনা বেতনে পড়ালেখার সুযোগ এবং মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা। নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় বর্তমান সরকার স্নাতক বা সমপর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করেছে।

শিক্ষার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা আনায় উন্নতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ‘Women in Parliaments Gobal Forum award’ শীর্ষক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে (মোট আসনের ২০ শতাংশ), যা ১৯৯১ সালের ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশ সরকার CEDAW (The Convention on the Elimination of all Forms of Discrimination Against Women), বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন ও এমডিজির উদ্দেশ্য অর্জনে এবং দেশের সংবিধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকল্পে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ গ্রহণ করেছে। এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ৪: শিশুমৃত্যু হার কমানো

বাংলাদেশ ‘শিশু মৃত্যুহার কমানো’ শীর্ষক সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যের অন্যতম প্রধান সূচক ‘পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার’ হ্রাসে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছে। বাংলাদেশ ২০১০ সালে শিশুমৃত্যু হার হ্রাসকরণে অর্জিত অগ্রগতির জন্য জাতিসংঘ পদকে ভূষিত হয়েছে। ১৯৯০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার ছিল ১০০০ জীবিত জন্মে ১৪৬ জন, যা ২০১৩ সালে ৪৬-এ নেমে এসেছে; অর্থাত্ এ সূচকের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশ লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে (২০১৫ সালের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৪৮)। ১৯৯০ সালে এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১০০০ জীবিত জন্মে ৯২ জন, যা ২০১৫ সালের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৩১ জনের বিপরীতে ২০১৩ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ৩২-এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে এক বছর বয়সী শিশুর হামের টিকা গ্রহণের অনুপাত ১৯৯০ সালের ৫৪ শতাংশ থেকে ২০১৪ সালে ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রসারণ টিকাদান কর্মসূচি, ডায়রিয়া নিরাময় ও সম্পূরক ভিটামিন ‘এ’ সরবরাহ কর্মসূচি এক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রেখেছে। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সাশ্রয়ী সমাধানে বাংলাদেশ বিশ্বপরিমণ্ডলে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এর অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে রয়েছে শিশুদের ডায়রিয়া নিরাময়ে জিঙ্কের ব্যবহার, স্বল্প ব্যয়ে খাবার স্যালাইন আবিষ্কার, ডেলিভারি কিট প্রবর্তন, গর্ভবতী মায়েদের জন্য জলাতঙ্কের টিকা প্রদান এবং আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার। এসব প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন ও উন্নয়ন এ দেশেই হয়েছে এবং পরবর্তীতে অন্য দেশগুলোও অনুকরণ করেছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ৫: মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন

শিশুমৃত্যুর হার কমানোর মতো সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের পঞ্চম লক্ষ্য মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ লক্ষ্যের শীর্ষ সূচক মাতৃমৃত্যু হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জনে সমর্থ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যু হার ছিল ৫৭৪, যা ২০১৩ সালে হয়েছে ১৭০। বিভিন্ন সালে পরিচালিত জরিপের উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, সামগ্রিকভাবে প্রজনন বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার বিগত বছরগুলোয় ধারাবাহিকভাবে কমে এসেছে। সার্বিক স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার ‘জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১’ গ্রহণ করেছে এবং ‘জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২’ চূড়ান্ত করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষত মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে ১২ হাজার ২১৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ব্যবহার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১১ সালে মহিলা ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক সাউথ-সাউথ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।

অন্যদিকে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন-সংক্রান্ত লক্ষ্যের অন্য সূচকের মধ্যে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে সেবা গ্রহণের হার গত দুই দশকে প্রায় আট গুণ বেড়েছে। ১৯৯১ সালে এ হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। একই সময়ে প্রসব-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যকর্মী কর্তৃক প্রদত্ত সেবার আওতা বেড়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীর দ্বারা প্রসূতি মায়ের কমপক্ষে একবার পরিদর্শন ২৭ দশমিক ৫ থেকে ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং কমপক্ষে চারবার পরিদর্শন ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩১ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনার অপূরণকৃত চাহিদার পরিমাণ ২২ থেকে নেমে এসেছে ১২ শতাংশে। একই সঙ্গে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের হার এমডিজি ভিত্তি বছরের ৪০ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ৬: এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগব্যাধি দমন

এমডিজির ষষ্ঠ অভীষ্ট লক্ষ্যে অন্তর্ভুক্ত সংক্রামক রোগগুলো দমনে বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, দেশে এইচআইভি/এইডসের প্রাদুর্ভাব এখনো অনেক কম (শতকরা ০.১ ভাগেরও কম), যা মহামারী সীমার নিচেই রয়েছে। জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির ২০১৩ সালে ১৫-২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা রাখে এমন লোকের সংখ্যা ১৮ শতাংশ। এদিকে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কারণে বিগত বছরগুলোয় এ রোগে মৃত্যুবরণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ২০০৮ সালের প্রতি ১ লাখ জনে ১ দশমিক ৪ থেকে শূন্য দশমিক ৩৪-এ নেমে এসেছে। ১৩টি উচ্চ ম্যালেরিয়া ঝুঁকিসম্পন্ন জেলায় পতঙ্গ-নিরোধক রাসায়নিকযুক্ত মশারি ব্যবহারকারী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ২০০৮ সালের ৮১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উপযুক্ত ম্যালেরিয়ারোধী ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিত্সা করা হয়েছে জ্বরাক্রান্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী এমন শিশুর সংখ্যা ২০০৮ সালে ছিল ৬০ শতাংশ, ২০১৪ সালে এ হার ১০০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৯০ সালে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রতি ১ লাখে ৮০; ২০১৪ সালে এসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১-এ। এতে প্রতীয়মান যে, ২০১৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশ সঠিক পথে চলমান।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ৭: পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ

‘পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও বেশকিছুটা উন্নতি হয়েছে এবং জলবায়ু ও পরিবেশগত অবস্থার অবনতি হয়নি। ১৯৯০ সালে দেশে বনাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক শূন্য শতাংশ; যা ২০১৪ সালে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে ‘ওজোন’ ক্ষয়কারী পদার্থের পরিমাণ ২০২ ওডিপি টন থেকে হ্রাস পেয়ে ৬৪ দশমিক ৮৮ হয়েছে। সংরক্ষিত ভূমি ও জলাশয়ের পরিমাণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ৯১ থেকে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। ১৯৯০ সালে জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বস্তিতে বাস করত; বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ৮: সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা

দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে গড় বার্ষিক বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এর মধ্যে অনুদান ও ঋণসহায়তার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৬৩ ও ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মোট দেশজ উত্পাদনের তুলনায় বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ ১৯৯০-৯১-এর ৫ দশমিক ৫৯ থেকে ২০১৩-১৪তে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এ সময়ে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা অবমুক্তির পরিমাণ মাথাপিছু বার্ষিক ১৯ দশমিক ৭৯ থেকে ৭ দশমিক ৬০ মার্কিন ডলারে নেমেছে। মোট ৩৪টি ওইসিডি দেশের মধ্যে মাত্র নয়টি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ৭৪৮ দশমিক শূন্য ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে; এটি ওই বছরে বাংলাদেশ মোট যে পরিমাণ বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা পেয়েছে, তার মাত্র ২২ শতাংশ। এমডিজি বাস্তবায়নে সহায়তার পরিমাণ ছিল চরমভাবে অপ্রতুল এবং উন্নত দেশগুলোর অধিকাংশই সহায়তা প্রদানে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সফল হয়নি।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার জাতিকে ‘রূপকল্প ২০২১’ বা দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রদান করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, যেখানে দারিদ্র্য নিম্নতম পর্যায়ে কমিয়ে আনা হবে এবং বৈষম্য হ্রাস করা হবে। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সরকার ২০১১-১৫ মেয়াদে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করে। এ পরিকল্পনায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোকে একীভূত করে বিভিন্ন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যা এমডিজি অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পরিকল্পনাটির মেয়াদও এমডিজির সঙ্গে সমন্বয় করে ২০১৫ সাল করা হয়। রূপকল্পের নির্ধারিত সময়সীমার আগেই সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা, জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন, তাদের নিরলস ও কঠোর পরিশ্রমে বাংলাদেশ ২০১৫ সালেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘UN MDG Awards 2010’ পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের সাফল্য অগ্রযাত্রা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এমডিজি অর্জনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাপ্ত পুরস্কার বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে উচ্চতর স্থানে এবং অনুন্নত দেশগুলোর রোল মডেলে পরিণত করেছে। ‘The Rise of the South’ শীর্ষক জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০১৩-এ বলা হয়েছে, এমডিজি অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে, এমন ১৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এসব স্বীকৃতি ছাড়াও বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মোকাবেলায় অভাবনীয় অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

এমডিজির সময়সীমা অতিক্রম করার আগেই ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা নিয়ে বিশ্বদরবারের বিভিন্ন প্লাটফর্মে আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে জাতিসংঘে প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছে। পরিতৃপ্তির বিষয় হলো, এর মধ্যে অধিকাংশই ভবিষ্যত্ ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’র জন্য বিবেচিত হয়েছে। এমডিজি অর্জনে সাফল্য-ব্যর্থতার আলোকে বাংলাদেশ ভবিষ্যত্ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে অচিরেই বাংলাদেশ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, যা ভবিষ্যতে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীতব্য ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’ অর্জনের মূল চাবি হিসেবে কাজ করবে।