বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগের উদ্যোগ

বদেশে থেকেই বিদেশে সুনাম অর্জনকারী শিল্পোদ্যোক্তাদের চোখে এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। সুদূর আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি দেশে তৈরি পোশাক ও ওষুধশিল্পে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে দেশের খ্যাতনামা চারটি প্রতিষ্ঠান। আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় পোশাক খাতে বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ স্কয়ার ও এসিআই। এ ছাড়া একই খাতে পূর্ব ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়ায় বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। এ চার প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য অর্থ স্থানান্তরের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, ইথিওপিয়ায় তিন কোটি ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে ডিবিএল গ্রুপ। এ জন্য এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ইথিওপিয়ায় অর্থ স্থানান্তরের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটানে নিজস্ব ব্র্যান্ড গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করছে গ্রুপটি। এ বছরই ইথিওপিয়ায় কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করবেন ডিবিএল গ্রুপের প্রাণ চার সহোদর, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বড় ভাই দুলালের নামে মাত্র ৪০টি সেলাই মেশিন নিয়ে ব্যবসায় নেমেছিলেন ২৪ বছর আগে।

বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অপবাদ দেওয়া হেনরি কিসিঞ্জারের (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী) দেশে ওষুধ উৎপাদন, গবেষণা ও বিক্রি করবেন বাংলাদেশের

ব্যবসায়ীরা। এ খাতে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও এসিআই। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের জন্য নিয়ে গেছে ৫০ লাখ ডলার, এসিআই নিয়েছে চার লাখ ৪৭ হাজার ডলার। আর যৌথ উদ্যোগে এস্তোনিয়ায় ব্যবসা করার জন্য প্রাথমিকভাবে আড়াই হাজার ইউরো নিয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আফ্রিকা বা অন্য কোথাও জমি চাষের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগের অনুমতি দেবে না। দেশেই এখনো অনেক অনাবাদি জমি রয়েছে, আগ্রহীরা সেগুলো চাষাবাদ করতে পারেন। তবে বাংলাদেশের বেশ কিছু বৃহৎ শিল্প গ্রুপ এখন দুনিয়াজুড়ে ব্যবসা করার সক্ষমতা অর্জন করছে। অনেকেই আবেদন করছে, যাচাই-বাছাই করে আমরা তিনটি ওষুধ কম্পানি ও একটি গার্মেন্ট কম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন বিশ্বজুড়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইথিওপিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করে সেখান থেকেই রপ্তানি করার আগ্রহ প্রকাশ করে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে ডিবিএল গ্রুপ। আমরা তাদের সেখানে বিনিয়োগের জন্য অর্থ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছি। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বিনিয়োগের জন্য স্কয়ার, এসিআই ও ইনসেপ্টাকে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মার্কেট রিসার্চ, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ও বায়ো রিসার্চে বিনিয়োগ করতে যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ লাখ ডলার নিয়ে গেছে স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস। ইনসেপ্টা দুই হাজার ৫০০ ইউরো এস্তোনিয়ায় নিয়ে গেছে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা করার জন্য। এসিআই জেনেরিক মেডিসিন উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য রেজিস্ট্রেশন ও লঞ্চিং ফি বাবদ চার লাখ ৪৭ হাজার ডলার নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। সম্প্রতি এই কয়েকটি প্রস্তাবে অনাপত্তি দিয়েছে বাংলাদেশ। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের জন্য এক্সপোর্টার রিটেনশন কোটা বা ইআরকিউ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে বৈধভাবে বিদেশে অর্থ বিনিয়োগ করা যায়।

জানতে চাইলে ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও গ্রুপ সিইও এম এ রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইথিওপিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনে অর্থ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চেয়েছিলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের ৯৫ লাখ ডলার নেওয়ার অনাপত্তি দিয়েছে। এটি মোট বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ ইথিওপিয়ার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা হবে। কারখানাটির মালিকানার শতভাগ ডিবিএলের থাকবে। চলতি বছরের শেষেই কারখানা নির্মাণকাজ শুরু হতে পারে। ওই কারখানায় মূলত নিটওয়্যার পণ্য (গেঞ্জি) উৎপাদনের পর শতভাগ রপ্তানি করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘ইথিওপিয়ায় বিনিয়োগ করলে যে অনেক মুনাফা হবে, তা নয়। বরং বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়াবে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইথিওপিয়ার শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা রয়েছে, দেশটিতে তুলাসহ তৈরি পোশাক পণ্যের কাঁচামালেরও পর্যাপ্ত জোগান রয়েছে। তাই সেখানে কারখানা স্থাপনের পর সফলভাবে তা পরিচালনা করতে পারলে দেশটিতে বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে ডিবিএল গ্রুপের।’

এম এ রহিম বলেন, ‘প্রায় দেড় বছর ধরে ইথিওপিয়ায় বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি আমরা। দেশটির তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সভাপতি এবং ভারতে নিযুক্ত ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে এসে আমাদের গ্রুপের কারখানা পরিদর্শন করেছেন, অন্যান্য প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেছেন। আগামী ১০ আগস্ট আমি ইথিওপিয়ায় যাচ্ছি, সেখানে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে। বাংলাদেশে আমরা ব্যাক টু ব্যাক এলসিসহ যেসব সুবিধা পাই, তা ইথিওপিয়াকে জানাব। ডিবিএল গ্রুপের কারখানাকে ইথিওপিয়া কী কী প্রণোদনা ও নীতি সুবিধা দেবে তার লিখিত নিশ্চয়তা নেব আমরা। কারখানা স্থাপনের পর কাজ শুরুর সময় বাংলাদেশ থেকে গুটিকয়েক এক্সপার্ট সেখানে নিয়োগ দেওয়া হবে, বাকি সব ক্ষেত্রে ইথিওপিয়ার শ্রমিকরা কাজ করবে। শুরুতে ওই কারখানায় উৎপাদিত নিটওয়্যার রপ্তানি করে বছরে ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে, পরে আস্তে আস্তে বাড়বে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইথিওপিয়ায় আমাদের ব্যবসা বড় করার পরিকল্পনা আছে। শুরুতে নিটওয়্যার দিয়ে যাত্রা করছি। উৎপাদন সক্ষমতা ও পারিপার্শ্বিক সুবিধা নিশ্চিত হলে ভবিষ্যতে সেখানে আমরা টেক্সটাইল, নিটিং ও ডাইং কারখানাও স্থাপন করব। তা ছাড়া দেশটি নিজেরাই যেহেতু প্রচুর তুলা উৎপাদন করে, তাই তৃতীয় ধাপে সেখানে স্পিনিং মিল করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। চলতি বছরের মধ্যেই আমরা যাতে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করি সে জন্য অনুরোধ করছে ইথিওপিয়া কর্তৃপক্ষ।’

নিজেদের ব্যবসা শুরুর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে এম এ রহিম বলেন, ‘আমরা পাঁচ ভাই ছিলাম। এখন আছি চারজন। বড় ভাই আবদুল কুদ্দুস দুলাল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে শহীদ হন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে দুলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেড, যা সংক্ষেপে ডিবিএল নামে ১৯৯১ সালে ফার্মগেটের নিজস্ব বাড়িতে ৪০টি সেলাই মেশিন নিয়ে ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করি বাকি চার ভাই। এখন আমাদের গ্রুপে কর্মজীবীর সংখ্যা ২২ হাজার ৩০০। বছরে ৩৩ কোটি ডলার টার্নওভার, রপ্তানি করি ১৮ কোটি ডলার। দেশের ভেতরেও নতুন নতুন কারখানা স্থাপন করছি আমরা। ২০১৬ সালের শেষে বা ২০১৭ সালের শুরুতেই সেগুলো চালু হবে। তখন ডিবিএল গ্রুপের টার্নওভার দাঁড়াবে ৫০০ কোটি ডলার, কাজ করবে ৪০ হাজার মানুষ।’