দুর্লভ পুরাকীর্তির ভাণ্ডার বিক্রমপুর জাদুঘর

লেখক : সাংবাদিক এ কে এম ওবায়দুর রহমান

দেশের অতিপ্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ বিক্রমপুর। রাজধানী হিসেবে ঢাকার বয়স চারশ’ বছর। কিন্তু প্রাচীন পূর্ববঙ্গ বা সমতটের রাজধানী হিসেবে বিক্রমপুরের খ্যাতি ১২শ’ থেকে ১৫শ’ বছরের। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলটি বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের জন্য সুপরিচিত। রাজধানী ঢাকা থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ জেলায় অন্তর্গত এ অঞ্চলটি অতি প্রাচীনকালে বাংলার রাজধানী ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিক্রমপুর ছিল রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী। বিক্রমাদিত্য হিন্দু পুরাণের একজন রাজা। এ অঞ্চলে জন্ম নেয়া বৌদ্ধ ধর্মগুরু, পণ্ডিত, দার্শনিক, পরিব্রাজক-প্রচারক অতীশ দীপঙ্করের জন্মভিটার অদূরে রঘুরামপুর গ্রামে ২০১১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে আবিষ্কৃৃত হয় নবম-দশম শতাব্দীর একটি বৌদ্ধবিহার (বৌদ্ধদের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়)। ২০১৪ সালে নাটেশ্বরে মাটির নিচ থেকে আবিষ্কার করা হয় বৌদ্ধ মন্দির কমপ্লেক্স। অনুসন্ধানে জানা যায় বিক্রমপুর ছিল প্রাচীন চন্দ্র ও বর্ম রাজবংশের এবং সর্বশেষ সেন রাজাদের রাজধানী। সেখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে হাজার বছর আগের নৌকা, কাঠের ভাস্কর্য, পাথরের ভাস্কর্য, টেরাকোটাসহ অসংখ্য অমূল্য প্রত্নবস্তু। এসব নিদর্শন বাঙালি জাতির উন্নত রুচি ও কৃষ্টি-কালচারের পরিচয় বহন করে বলেই প্রতীয়মান হয়।

 

বিক্রমপুর জাদুঘর

 

শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল ইউনিয়নের উত্তর বালাশুর গ্রামে জমিদার রাজা শ্রীনাথ রায়ের বাড়ি। এ পরিবারের সর্বশেষ জমিদার ছিলেন যদুনাথ রায়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর প্রজাহিতৈষী এ জমিদারকে সাম্প্র্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী তার বিপুল ভূ-সম্পত্তি ও বাড়ি থেকে উত্খাত এবং দেশত্যাগে বাধ্য করে। প্রায় তিনশ’ সবুজ গাছ-গাছালিতে ঢাকা ছিমছাম ছায়াশীতল স্বদেশানুরাগী এই জমিদারের বাড়িতে বর্তমানে স্থাপন করা হয়েছে ‘বিক্রমপুর জাদুঘর’ ও দেশের একমাত্র ‘নৌকা জাদুঘর’। জমিদার বাড়ির সামনে রয়েছে বিশাল দুটি দীঘি ও শান বাঁধানো বড় বড় ঘাট। এ জাদুঘর চত্বরের আয়তন সাড়ে ১৩ একর। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের আলোকে গড়ে তোলা এ জাদুঘরে রয়েছে দশম শতাব্দী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের ঐতিহাসিক নানা প্রত্নবস্তু।

 

বিক্রমপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করে। জমিদার যদুনাথ রায়ের পরিত্যক্ত এ বাড়িটি অগ্রসর বিক্রমপুর সরকারের কাছ থেকে লিজ নেয়। জাদুঘরটি দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছে সংগঠনটি। জেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত এই ভবনটি ২০১৩ সালের ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। ২০ জুন, বিক্রমপুর জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। এ জমিদার বাড়িতে রয়েছে দু’শ’ বছর আগে নির্মিত মন্দিরসহ বিশাল বিশাল পুরাতন ভবন। তার মাঝে বিরাট পুকুর। শান বাঁধানো ঘাট। সাম্পান নৌকা। ভবনগুলোর পাশেই স্থাপন করা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর।

 

অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শ্রীনগরের রঘুরামপুর ও নাটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়। এসব খননে প্রাচীন বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। পাওয়া গেছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। একশ’টির মতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘরটি। তিনতলা ভবনের জাদুঘরের মূল ফটকের দু’পাশে রয়েছে দু’টি বড় মাটির পাতিল। নিচতলার বাঁ পাশের গ্যালারিটি জমিদার যদুনাথ রায়ের নামে। এ জাদুঘরে রয়েছে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, এখানকার বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রীর আলোকচিত্র, বৌদ্ধবিহার, হযরত বাবা আদম (রা.) শহীদ মসজিদ, ইন্দ্রাকপুর কেল্লা, অতীশ দীপঙ্করের পরিচিতিমূলক আলোকচিত্র। এছাড়া জাতীয় জাদুঘর, বরেন্দ্র জাদুঘর ও কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত কষ্টিপাথরের মূর্তিগুলোর আলোকচিত্র। এখানে রয়েছে রঘুরামপুর, নাটেশ্বরসহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির নল, মাটির পাত্র, পোড়ামাটির খেলনাসহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন। বিক্রমপুরের বিভিন্ন মনীষীদের পরিচিতিসহ আলোকচিত্র, বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, মঠ ও মন্দিরের আলোকচিত্র রয়েছে জাদুঘরে। জাদুঘরের নিচতলার দু’টি কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গ্যালারি ও জমিদার যদুনাথ রায় গ্যালারি। এছাড়া পুরো জাদুঘর ও জমিদার বাড়ি নিয়েও কর্তৃপক্ষের রয়েছে মহাপরিকল্পনা। এ বিষয়ে লেনিন বলেন, জমিদার বাড়ির পশ্চিমে দীঘির পাড়ে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা করা হবে। আর বাড়ির বিশাল খালি জায়গায় বসানো হবে উন্মুক্ত প্রদর্শনী যার নাম ‘ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ’। তিনি জানান, এ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বসতবাড়ির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ঘর ও উঠান প্রদর্শিত হবে এবং এসব বাড়ি সজ্জিত করা হবে ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, নকশা ও উপকরণ দিয়ে। সেখানে থাকবে উপজাতিদের বাহারী রঙের নকশা করা ঘর, কাঠ ও মাটির তৈরি একতলা-দোতলা ঘর। সেখানে রাখা হবে প্রায় বিলুপ্ত হওয়া চাল কাটা ঢেঁকিসহ নানান গ্রামীণ ঐতিহ্য।

 

এই অঞ্চলে বাংলার বহু কীর্তিমান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। এখানকার কৃতী সন্তানের মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত সাধক অতীশ দীপঙ্কর, বাঙালির গর্ব, বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, বেতার তরঙ্গ ও চুম্বক তরঙ্গের মৌলিক আবিষ্কারক, উদ্ভিদের জীবন ও অনুভূতির আবিষ্কারক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, বিখ্যাত সাঁতারু ব্রজেন দাস, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সত্যেন সেন, রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন দাস, লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কথা-সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কবি বুদ্ধদেব বসু, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু, গণিতশাস্ত্রবিদ অধ্যাপক রাজকুমার ঘোষ, পূর্ববঙ্গে সর্বপ্রথম বস্ত্রকল নির্মাতা সূর্য কুমার বসু ও প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদ।