সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সদ্য বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায়। যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় তিনগুণ বা সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এত বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি।
সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে লাগাম টানতে অর্থবছরের শেষদিকে অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই এর সুদহার কমিয়েছে সরকার। যা গত ২৩ মে থেকে কার্যকর হয়েছে। সুদহার কমানো সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। কারণ সুদহার কমানোর পরও এর সুদের হার ব্যাংকের সুদের চেয়ে বেশি রয়েছে। গেল অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।
এদিকে, মাসের শেষ সময়ে সুদহার কমানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা। তাড়াহুড়ো করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এ সিদ্ধান্তের ফলে মানুষের মধ্যে সঞ্চয় করার প্রবণতা কমে যাবে অথবা শেয়ারবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে এ বিনিয়োগ চলে যাবে যা অর্থনীতির জন্য মোটেও কল্যাণ বয়ে আনবে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মানবকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকের তুলনায় সুদহার বেশি হওয়ায় এবং কোনো ধরনের ঝুঁকি না থাকায় বর্তমানে সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন গ্রাহকরা। সুদের হার কমানোর পরও এ খাতে বিনিয়োগ কমেনি এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকে সাধারণ মানুষ এখনো নিরাপদ মনে করছে। কেননা দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না। আবার শেয়ার বাজারের মন্দাভাবও কাটছে না। তাই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরও বিনিয়োগ কমেনি। তবে ভবিষ্যতে এ খাতে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, হঠাৎ করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত সরকারের মোটেও ঠিক হয়নি। এতে করে প্রথমত, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে যেতে পারে। ফলে তারা আগের তুলনায় বেশি ভোগব্যয় করতে পারে অথবা শেয়ারবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে এ বিনিয়োগ চলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সমবায়ের নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠতে পারে। যেখানে বেশি লাভের আশায় বিনিয়োগ করে সাধারণ বিনিয়োগবকারীরা প্রতারিত হতে পারে। তাই এ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারকে আরো বেশি চিন্তা-ভাবনা করা উচিত ছিল।
সঞ্চয় অধিদফতরের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় তিনগুণ বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। আলোচ্য সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ এসেছে ২৮ হাজার ৭৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বেশি। এ সময়ে নিট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। বিক্রির এ পরিমাণ সরকারের বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণ করবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। ক্রমাগত বিক্রি বাড়ায় সেই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু অর্থবছরের এক মাস বাকি থাকতেই সেই লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। আলোচ্য সময়ে মূল্য পরিশোধ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১৩ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৯ হাজার ৮১৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। গেল অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্থবছর শেষে নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্বক (-) ৬ হাজার ৮৬৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি ঋণ বেসরকারি খাতকে বেকায়দায় ফেলছেন এমন আলোচনা একসময় বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমাতে এবং জনগণের সঞ্চয় উৎসাহিত করতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ানো হয়। দেশে বিনিয়োগে ধীরগতিতে ব্যাংক খাতে বড় অঙ্কের উদ্বৃত্ত তহবিল জমা হলে ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে সুদহার কমাতে শুরু করে। তবে সঞ্চয়পত্রের সুদ আগের মতোই আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মাসুম কামাল ভূঁইয়া মানবকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকের সুদহার কমে আসা ও শেয়ারবাজারে নি¤œমুখী প্রবণতার ফলে অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। এতে প্রত্যাশার তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে অনেক বেশি অর্থ এসেছে। কিন্তু সরকারকে সবদিকেই নজর দিতে হয়। তাই প্রয়োজনে যেমন সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ানো হয়েছিল, তেমনি বর্তমান পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।