সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে ছোট আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ব্যর্থ হওয়াতে এখন এই উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এতে বিনিয়োগও নেমে আসবে অর্ধেকে। তাছাড়া ছোট আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কম বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলোও অর্থায়নে আগ্রহী হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আইপিপির (ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) আওতায় বিগত সরকারের আমলের কয়লাভিত্তিক বড় বড় প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোক্তারা তা নির্মাণে ব্যর্থ হওয়ায় এখন ছোট ছোট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার সেমি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিনির্ভর এসব প্রকল্প সমঝোতা বা দরপত্রের মাধ্যমে করা হবে। যদিও বিগত সরকারের আমলে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই কয়লাভিত্তিক বড় বড় প্রকল্প বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দেয়া হয়েছিল। তখন উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা ও বিনিয়োগের সক্ষমতা বিবেচনা করা হয়নি। আইপিপি ভিত্তিতে তখন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সাথে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হলেও এখনো কোনো উদ্যোক্তাই সরকারকে অর্থায়নের উৎস নিশ্চিত করতে পারেনি।
সূত্র জানায়, খুব শিগগিরই দেশে ছোট ছোট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। বর্তমান উদ্যোগে বিনিয়োগের পরিমাণ কম হওয়াতে অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তাই এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে আগ্রহী। তাছাড়া দেশে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেও এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজন হবে। ছোট আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কম বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলোও অর্থায়নে আগ্রহী হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া ২০১০-১১ সাল থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো দেশে নতুন কোনো কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বেসরকারি খাত। সরকার যৌথ উদ্যোগে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেগুলোর অগ্রগতিও সামান্যই। কবে নাগাদ ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শেষ হবে নির্দিষ্ট করে তা বলা যাচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে যৌথ উদ্যোগ, আইপিপি এবং সরকারি মিলিয়ে ২০টি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-আপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মাত্র একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থায়নের নিশ্চিয়তা দিয়েছে। বাকি ১৯টির অর্থায়ন এখনো নিশ্চিত হয়নি। ফলে ১৭ হাজার ৬৮৮ মেগাওয়াটের কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে ঝিমিয়ে পড়েছে। অথচ প্রতিবছরই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদনে আসার সময়সীমা বাড়ানো হচ্ছে। শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে ২০১৫ সালে। এখন বলা হচ্ছে প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৮ সালে। কিন্তু বাস্তবতায় এ সময়সীমাও অতিক্রম করে যাবে। কারণ ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা দ্বিতীয়বারের মতো বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া আইপিপি প্রকল্প রয়েছে ৮টি। পাশাপাশি একটি বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও রয়েছে। বিএসআরএমএস চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে ১৫০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে। তবে উদ্যোক্তার পক্ষ থেকে এ কেন্দ্রের লাইসেন্স জটিলতা সরকারকে অবহিত করেছে। এ প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছে। তাছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে আগ্রহী। শুরুতে তারা ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিলেও এখন সংশোধিত প্রস্তাবে তারা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার কথা বলছে। খুলনা এবং ঢাকায় ওরিয়ন গ্রুপের দুইটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু এখনো ওই দুটি কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ কবে শুরু হবে তা সরকারকে জানাতে পারেনি। আর মেঘনা ঘাট-৬৩৫ মেগাওয়াট, মেঘনা ঘাট-২৮২ মেগাওয়াট, আনোয়ারা-২৮২ মেগাওয়াট, এস আলম গ্রুপের চট্টগ্রাম-৬১২ মেগাওয়াটের ২টি কেন্দ্রের সাথে এখনো পিডিবি চুক্তি করতে পারেনি।
এদিকে পিডিবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন- এদেশে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই। আর পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্রই চালাতে হবে আমদানি করা জ্বালানি দিয়ে। তাতে কে কতোদিন কয়লা দেবে, কীভাবে কয়লা পরিবহন করা হবে- তার কোনো অভিজ্ঞতা দেশের কোনো উদ্যোক্তারই নেই। এ কারণে যারা দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা হয়েছে তাদের কেউ কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং অপেক্ষাকৃত নতুন উদ্যোক্তারাই কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছে। অথচ তাদের অর্থায়ন সংগ্রহের অভিজ্ঞতা নেই। সবকিছু মিলিয়ে যেয আশা নিয়ে উদ্যোক্তাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছিল তা এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে দেশে কয়লাভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান- কয়লাভিত্তিক বড় বড় বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। কোথাও থেকে এ ঋণ নিতে গেলেও অন্তত ৩০ শতাংশ কোম্পানির নিজস্ব বিনিয়োগ থাকতে হয়। কিন্তু দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাছে এতো টাকা নেই। তাদের উচিত ছিল যৌথ উদ্যোগে অভিজ্ঞ কোনো কোম্পানির সাথে কাজ করা। কিন্তু কেউ সে ধরনের উদ্যোগ নেয়নি। ফলে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই এখন ছোট ছোট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।