স্বাধীন দেশের নাগরিকের পূর্ণ মর্যাদা পাচ্ছেন ছিটমহলের বাসিন্দারা Åআজ রাত ১২টা ১ মিনিটে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশের এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলোতে উড়বে ভারতের পতাকা Å৬৮ বছরের দুঃসহ জীবনের অবসানের প্রতীক হিসেবে আজ মধ্যরাতে জ্বলবে ৬৮টি করে মোমবাতি
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপর অবসান ঘটবে তাদের দীর্ঘ ৬৮ বছরের দুঃসহ ও গ্লানিকর জীবন যাপনের। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ‘ছিটমহল’ নামক ক্ষুদ্র ভু-খণ্ডগুলোতে এত বছর ধরে বসবাস করে আসা মানুষেরা আজ দিবাগত মধ্যরাত থেকে পাবে স্বাধীন দেশের নাগরিকের পূর্ণ সম্মান, মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা। আজ রাত ১২টা ১ মিনিটে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহলে (এতদিন যেগুলো ভারতের মালিকানাধীন ছিল) উড়বে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। একই সময় ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ৫১ ছিটমহলে (এতদিন যেগুলো বাংলাদেশের মালিকানাধীন ছিল) উড়বে ভারতের জাতীয় পতাকা। ৬৮ বছরের দুঃসহ জীবনের যবনিকাপাতের প্রতীক হিসেবে ছিটমহলগুলোতে আজ মধ্যরাতে জ্বালানো হবে ৬৮টি করে মোমবাতি।
মুক্ত-স্বাধীন জীবনের স্বাদ নিতে উন্মুখ ছিটমহলের মানুষগুলো জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের এই ক্ষণকে স্মরনীয় করে রাখতে নিয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আজ মধ্যরাতেই ছিটমহলের রাস্তায় রাস্তায় মোমবাতি, মশাল নিয়ে আনন্দ মিছিলে যোগ দেবে সেখানকার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।
গতকাল বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে এক অনুষ্ঠানে উভয়দেশের ছিটমহলের ‘খণ্ড মানচিত্র’ (স্ট্রিপ ম্যাপ) হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পেল ১১১ ছিটমহল। আর ভারত পেল ৫১ ছিটমহল। আমাদের ভূমি মন্ত্রণালয় ১১১ ছিটমহলকে বাংলাদেশের অংশ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করবে। এখন থেকে এগুলো আর ‘ছিটমহল’ বলে পরিচিত হবে না। আপতত ছিটভিত্তিক নম্বর দিয়ে পরিচয় নির্ধারন করা হবে।
খণ্ডমানচিত্র হস্তান্তর করেন বাংলাদেশের পক্ষে দিল্লীতে বাংলাদেশি হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এবং ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পংকজ শরণ। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শফি্উল আলম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান, অতিরিক্ত সচিব এ কে এম রহমতুল মুনিম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া) ভূমি রেকর্ড জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল জলিলসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, এ হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হল। এটি একটি ঐতিহাসিক মূহূর্ত।
সম্প্রতি শেষ হওয়া যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১ ছিটমহলের লোকসংখ্যা ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। ভারতীয় ভূ-খণ্ডে থাকা ৫১ ছিটমহলের লোকসংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১ ছিটমহলে জমি আছে ১৭ হাজার ১৬০ একর। পক্ষান্তরে ভারতে থাকা ৫১ ছিটমহলে জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর। এখানে বাংলাদেশের প্রাপ্য অপদখলীয় জমি আছে ২ হাজার ২৬৭ একর এবং ভারতের প্রাপ্য আছে ২ হাজার ৭৭৭ একর। সর্বশেষ গত ৫ জুলাই যে গননা হয়েছে তা এখনো চূড়ান্ত করতে কিছুটা সময় লাগবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) এ কে এম রহমতুল মুনিম জানিয়েছেন। তিনি জানান, শুক্রবার মধ্যরাতের পরই বিনিময় কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। এবং নাগরিকত্ব দেয়ার কাজও শুরু হবে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র জন্মের সময় সীমারেখা নির্ধারনে লর্ড মাউন্টবেটন এর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। ওই বছরের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। এর ক’দিন পর ১৩ আগস্ট তিনি এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা হয়। অভিযোগ আছে গভীর ভাবনা চিন্তা ছাড়াই জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সময় না নিয়েই সীমানা মানচিত্র তৈরি করা হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেলেও অনেক পরে স্বতন্ত্র রাজ্য কুচবিহারের মহারাজা নারায়ণ ভুপ বাহাদুর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের কুটনৈতিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হন। ভারত ও পাকিস্তান অংশে বিভিন্ন মৌজায় রাজার খাস খতিয়ানভূক্ত জমি ভারতের অধীনে চলে গেলে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টি মোট ১১১ টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। যার আয়তন ১৭১৫৮.১৩ একর। সর্বশেষ ৬-১৬ জুলাই যৌথ সমীক্ষানুযায়ী, এখানের ৪১ হাজার ৪৪৯ জন নাগরিকের মধ্যে ঠিকানা পরিবর্তন করে ভারতের মুল ভূখন্ডে যাওয়ার আবেদন করেছেন ৯৭৯ জন। তাদেরকে বিশেষ নিরাপত্তায় ১ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বুড়িমারী, হলদিবাড়ি ও সাহেবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
অন্যদিকে ময়মনসিংহের কাশিমবাজার স্টেটের মহারাজা শ্রীশ চন্দ্র নন্দী, কুড়িগ্রামের পাঙ্গারাজা শচীন চন্দ্র কোঙ্গার, দিনাজপুরের মহারাজা গিরীজা প্রসাদ, রংপুরের রাজা জগত্ ভূপেন্দ্র নারায়ণ ও নীলফামারীর মহারানী বৃন্দা রানী পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ভারতীয় ভূ-খন্ডের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মৌজায় অবস্থিত নিজস্ব খাস খতিয়ানভূক্ত জমিগুলো তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। এর সংখ্যা ৫১ টি। এগুলো ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা ও তুফানগঞ্জ মহকুমার অভ্যন্তরে অবস্থিত। যার আয়তন ৭ হাজার ১১০দশমিক ২ একর। জমিগুলো পৃথক মৌজায়। সেই মৌজার ভিতরে এক বা একাধিক এলাকার ছোট ছোট ছিট রয়েছে। সর্বশেষ যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ১৪ হাজার ২১৫ জনের কেউই ঠিকানা পরিবর্তনে রাজি হয়নি।
কীর্ত্তিকা সেন বিল্টু, নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ]ঐতিহাসিক এ মহুর্ত স্মরনীয় করে রাখতে কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা নিয়েছে ব্যাপক কর্মসূচী। মশাল ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রার্থনা, গ্রামীন খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, ঘোড় দৌড়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাড়িতে বাড়িতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা, সন্ধ্যায় ছিটমহলগুলোর প্রতি বাড়ীতে ৬৮টি করে মোমবাতি প্রজ্বলন, আলোকসজ্জা, রাত ০১ মিনিটে ৬৮ বার তোপধ্বনির আয়োজন করা হয়েছে।
আমিরুল ইসলাম হেলাল,কালীগঞ্জ(লালমনিরহাট) সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের লালমনিরহাট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম আশিক জানান, বিকেল ৪টায় দেশীয় খেলাধুলা, যেমন- হা-ড-ুডু,লাঠি খেলা,জারী ও ভাওয়াইয়া গান, সন্ধায় সারা ছিটমহলে মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করা, রাত ১২টায় ৬৮টি মোমবাতি একসাথে জ্বালানো, ১২.১ মিনিটে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন, ১ আগস্ট সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ছিটমহলের প্রতিটি বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মিষ্টি বিতরন করা হবে।
পাটগ্রাম (লালমনিরহাট) সংবাদদাতা আজিজুল হক দুলাল জানান,
দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেয়ে ছিটমহলের অধিবাসীরা বাংলাদেশী হওয়ায় অনেকে জীবন- ধারণের জন্য আগে মৌলিক অধিকার গুলোর মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিত্সা সেবার সুযোগ সমূহ আগে বাস্তবায়নের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ সংবাদদাতা জাকির হোসেন কবীর জানান, বাংলাদেশে থাকা ছিটমহলের ৪৬৭ ভারত যেতে আবেদন করে। হেডকাউন্টিং এর শেষ দিনে আরো ১৬টি পরিবারের ৫৯ জন ভারতে যাওয়ার জন্য পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক এর বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের ওপর গতকাল বৃহস্পতিবার পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত কোটভাজনী ছিটমহলের নতুন হাজীর হাট অস্থায়ী ক্যাম্পে ভারতে যাওয়ার জন্য নতুন ভাবে যারা আবেদন করছিলেন তাদের যাচাই বাছাইসহ মতামত নেওয়া হয় ।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি ফজলে ইলাহী স্বপন জানান, ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে ছিটমহলগুলোতে চলছে আনন্দ আর উত্সবের আমেজ।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরের দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবে ছিটবাসীরা। মধ্যরাতের মাহেন্দ্রক্ষনে ৬৮টি মোমবাতী জ্বালিয়ে ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবনের অবসান ঘটাবেন ছিটবাসীরা। পোড়ানো হবে আতশবাজী, উড়ানো হবে ফানুস।
নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায় চারটি ছিটমহলে ২০১৫ সালের জনগণনায় হেডকাউন্টিং জরিপে ১১৯টি পরিবারে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪৫ জন। কোন পরিবার সদস্য ভারতে যেতে জনগনার সময় আবেদন করেনি।