নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষা। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের শেষ মুহ‚র্তের মাহেন্দ্রক্ষণ। ছিটমহলের ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসবের প্রতীক্ষা। বাংলাদেশি হওয়ার ব্যাকুলতা সব বয়সী মানুষের মাঝে। আজ ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে ভারত-বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে ছিটমহল নামটি মুছে যাবে। ছিটমহলবাসীরা আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের নাগরিকত্ব পাবেন। সে আনন্দ উদযাপন করতে ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে মোমবাতি আর মঙ্গল প্রদীপ। ছিটমহলের রাস্তাগুলো মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে। সবাই মিলে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠবে জাতীয় সঙ্গীত। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকরাও এসব ভারতীয় নাগরিককে বরণ করে নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার দাসিয়ার ছড়ার কালিরহাট বাজারসহ জেলার ১২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা এ জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, আনন্দমেলা, বিভিন্ন খেলার অয়োজন, বাড়ি বাড়ি মোমবাতি প্রজ্বলন, রাস্তায় রাস্তায় মশালসহ রঙ-বেরঙের আলো জ্বালানো। শুধু তাই নয় ঐতিহাসিক
এ মুহ‚র্তকে স্মরণীয় করে রাখতে ইতোমধ্যে ছিটমহলের মানুষ ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ আতশবাজি সংগ্রহ করেছে। দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলে ঢুকতেই যেন চোখে পড়ে ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ। মধ্যরাতে ছিটমহলের আকাশ আতশবাজির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে, এমনটাই আশা নতুন নাগরিকদের।
এভাবেই ৬৮ বছরের বন্দি জীবনকে বিদায় জানিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নাগরিক হতে ব্যস্ত সবাই। মধ্যরাতে যখন পৃথিবী নিঝুম-নিস্তব্ধ থাকবে তখন ছিটমহলের সব বয়সী মানুষেরা এক নতুন জীবনে প্রবেশ করবে। যেখানে থাকবে রাষ্ট্রের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং চাওয়া পাওয়া। এ জন্যই ছিটের মানুষরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় দুই দেশের অভ্যন্তরে থাকা ১৬২টি ছিটমহলের মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দিতে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দারা ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু নানা টানাপড়েনের কারণে দীর্ঘদিনেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন পর শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এলে ছিটমহলের মানুষ দুর্বিসহ জীবন থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেন। আবারো শুরু হয় ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া। ২০১১ সালে দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে এ নিয়ে প্রটোকল স্বাক্ষরিত হলে ৬৮ বছর ধরে অবরুদ্ধ থাকা এসব মানুষ মুক্তির স্বাদ পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে। এর পর শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। এরই অংশ হিসেবে দুই দেশের সুপারভাইজারদের সমন্বয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের তদারকিতে গত ১৬ জুলাই জননিরীক্ষার কাজ সম্পন্ন হয়। জনগণনার সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটের ৪১ হাজার ৪৪৯ জন নাগরিকের মধ্যে মাত্র ৯৭৯ জন ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করায় তাদের বিশেষ নিরাপত্তায় বুড়িমারী, হলদিবাড়ি ও সাহেবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক খাঁন মোহাম্মদ নুরুল আমিন জানান, ছিটমহলের জনগণের উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যে সরকার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ জন্য তিনি ছিটমহলের উন্নয়ন তরান্বিত করতে জেলার সব দপ্তরের কর্মকর্তা ও এনজিও প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি জানান, আজ মধ্যরাত থেকে ভারতীয় ছিটমহলের ১৭ হাজার একর জমি বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে পরিণত হবে। এভাবেই ছিটমহল শব্দটি মানচিত্র থেকে মুছে যাবে। অন্যদিকে, কোচবিহারের জেলা প্রশাসক পি-উলাগানাথন এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান, ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা সব বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের ভূ-খণ্ড বলে চিহ্নিত হবে।