উন্নয়ন বাস্তবায়নে সরকারের চোখ এবার সচিবদের ওপর

সরকারের উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য এবার চোখ রাখা হচ্ছে সচিবদের ওপর। সচিবদের পারফরম্যান্স নির্ভর করছে তার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের গতিবিধি দেখে। একই সঙ্গে মাঠ প্রশাসনকে চাঙ্গা করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে আরো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কাজ করছে। খুব শিগগির সচিবদের নিয়ে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি জানায়, সততা, কর্মদক্ষতা, গতিশীলতাসহ বিভিন্ন বিষয়কে ধরে সচিবদের ক্যাটাগরি চিহ্নিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও গতিহীন সচিবদের কিভাবে জনপ্রশাসন থেকে বিদায় করা যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, জনপ্রশাসনে দক্ষতার বিষয়টি এখন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কারণ দক্ষতার ওপর সরকারের উন্নয়ন বাস্তবায়ন অনেকাংশে নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ওপর আলোচনাকালে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, জনপ্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর প্রশিক্ষণ হতে হবে যুগোপযোগী। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে মনিটরিং না করার ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকারি কাজের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, গতিশীল ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন সরকারি দফতর, সংস্থাগুলোর জন্য কর্মসম্পাদন পদ্ধতি প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত অর্থবছরে ৪৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তির নীতিমালা সম্প্রতি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ কর্ম সম্পাদনের জন্য সূচকের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অসাধারণ কর্মসম্পাদনকে শতভাগ আর চলতি মানের নিচে কর্মসম্পাদনকে ৬০ ভাগ স্কেল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অতি উত্তমের ক্ষেত্রে ৯০ ভাগ, উত্তমের ক্ষেত্রে ৮০ ভাগ ও চলতি মানের ক্ষেত্রে ৭০ ভাগ সূচক ধরা হয়েছে। বছরের কর্মসম্পাদন চুক্তি অর্জনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। আগামী বছর আগস্ট মাসে মূল্যায়ন প্রতিবেদন জাতীয় কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হবে। এর পাশাপাশি আগামী বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কার্যক্রম মূল্যায়ন নিয়ে ইতিমধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে সরকারের একটি সংস্থা। যেখানে বেশিরভাগ সচিবের পারফরম্যান্স ইতিবাচক হলেও, কোনো কোনো সচিব নিজের উদ্যোগে তাদের নিজ মন্ত্রণালয়ে নতুন কিছু কাজ বের করেন না। তারা শুধু নিয়মিত রুটিন ওয়ার্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে এখনো বেশ কয়েক সচিব রয়েছেন যারা দেশ ও দশের জন্য নিবেদিত। এদের সংখ্যা অবশ্য হাতেগোনা। প্রতিবেদন অনুসারে ২০টি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের পারফরম্যান্স দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তবে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবদের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে উদ্যোগ ও উদ্যম দুটিই রয়েছে। শুধু প্রয়োজন শীর্ষ পর্যায় থেকে কিছু গাইড লাইন দেয়া। বেশ কয়েক সচিব রয়েছেন যারা নীরবে তাদের কাজ করে যাচ্ছেন। কে তাদের মূল্যায়ন করল, কিংবা প্রশংসা করল, সে ব্যাপারে কোনো সরব নেই।
জানা গেছে, কাজপাগল এমন কয়েক সচিব রয়েছেন, তারা হয়তো খুব শিগগির অবসরকালীন প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে চলে যাবেন। এদের শূন্যতা পূরণের জন্য সরকার নতুন করে দক্ষ, মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা খুঁজছে, যাদের ভারপ্রাপ্ত হিসেবে সচিব পদে পদায়ন করা যায়। তবে আগামীতে অর্থ সচিব হিসেবে পদায়নের জন্য এখন থেকে সরকারের পক্ষ থেকে হান্টিং করা হচ্ছে। চলতি বছরেই চলে যাচ্ছেন বর্তমান অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ। অর্থ বিভাগের সঙ্গে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একটি মেলবন্ধন রয়েছে। এ মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করার জন্য যোগ্য ও কর্মদক্ষ সচিব হিসেবে কাকে নির্বাচন করা যায় সে বিষয়ে ইতিমধ্যে সরকারের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। খুব শিগগির জনপ্রশাসনে বেশ কয়েক সচিব পদে রদবদল আসছে। সেক্ষেত্রে সরকার খুব ভেবে-চিন্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বাণিজ্য সচিব, স্বাস্থ্য সচিব ও ভূমি সচিব নিয়োগ দেবে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। তবে ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের নাম শোনা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি বর্তমান জনপ্রশাসন সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও বাণিজ্য সচিব মো. হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের নাম শোনা যাচ্ছে। বর্তমান ভূমি সচিব মো. শফিউল আলম এদের একই ব্যাচের সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুপরিচিত হলেও, তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে কি-না সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে সচিবদের মধ্যে তার হাতের লেখা সবচেয়ে সুন্দর বলে জানা গেছে।
সচিবদের পারফরম্যান্স নিয়ে সর্বোচ্চ মহল একদিকে যেমন সন্তুষ্ট, অন্যদিকে কোনো কোনো সচিবের কর্মকাণ্ডে কিছুটা অসন্তুষ্ট। কিছুদিন আগে পরিকল্পনা বিভাগে এমন এক সচিবের দায়িত্বে ছিলেন যিনি তার দাফতরিক কাজের চেয়ে বেশি সময় দিতেন অন্য দিকে। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তার কার্যক্রমে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অথচ জনপ্রশাসনে মেধাবী, দক্ষ ও কবি হিসেবে সুপরিচিত বর্তমান জনপ্রশাসন সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর কাজের দক্ষতা নিয়ে সর্বোচ্চ মহল থেকে পুরো প্রশাসন সন্তুষ্ট। শুধু তাই নয়, তার কাজের গতিশীলতা অনেকের জন্য অনুসরণীয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ একজন ডায়নামিক ও চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে সমাদৃত। বিদ্যুৎ বিভাগে তার কাজের কারিশমা এখনো উদাহরণ হিসেবে সবার কাছে শিক্ষণীয়। বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন একাধারে কবি। আবার আমলা। সরকারের কাজের প্রতি সব সময় তার আনুগত্য রয়েছে। দক্ষতা ও সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র সচিবদের মধ্যে দুদকের সচিব মাকসুদুল হাসান খান, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, স্থানীয় সরকার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল মালেক, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ দাফতরিক কাজে নিবেদিত। জনপ্রশাসনে এমন কয়েক সচিব রয়েছেন তাদের দক্ষতা ও মেধা দিয়ে তারা নিয়মিত সুষ্ঠুভাবে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছেন। তবে এসব সচিবের ওপর সরকারের প্রত্যাশা অনেক বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে সচিবদের পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসকদের ওপর সর্বোচ্চ মহলের নজর বাড়ছে। প্রতি বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনের মতো এবারো সম্মেলন হতে যাচ্ছে। তবে তা একটু ব্যতিক্রমধর্মী। গত বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ নির্দেশনার বেশিরভাগ আজ আবার উচ্চারিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা, সরকারি জমি রক্ষা করা, সর্বক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা বাড়ানো, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি নির্মূল করাসহ আরো অনেক নির্দেশনা। তবে এবার নতুন মাত্রা হিসেবে যোগ হচ্ছে মানব পাচার বন্ধ করা।