‘ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ নেওয়া’ ঠেকাতে চালু হচ্ছে ই-ফাইলিং সিস্টেম। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জন্য তার কার্যালয়ে ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পাঠানো হবে। ফাইল নিয়ে ‘ফালাফালি’ দূর করতে এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিতের জন্যই এই ই-ফাইলিং সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। এ লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) অনলাইন প্লাটফর্মে যুক্ত হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। এই পদ্ধতিতে ৫০ কোটি টাকার বেশি সরকারি ক্রয়ে প্রধানমন্ত্রীর ইলেকট্রনিক্যালি অনুমোদন নেওয়া হবে। এ পদ্ধতি চালু হলে ফাইল ঠেকিয়ে অযাচিত অর্থ আদায়ের প্রবণতা কমে যাবে। অসাধু কর্মকর্তাদের বকশিশ আদায়ের লক্ষ্যে ফাইল লালফিতায় আটকে রাখার প্রবণতা কমে যাবে। এতে করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একদিকে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে; অন্যদিকে সময়ক্ষেপণ এবং দুর্নীতি কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে। খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ৫০ কোটি টাকার বেশি সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়ালি অনুমোদন করে থাকেন। অচিরেই তিনি এ অনুমোদন ইলেকট্রনিক্যালি করবেন। এতে আমাদের অনেক সময় বাঁচবে। উন্নয়ন কাজও ত্বরান্বিত হবে। আমরা শিগগিরই এই পদ্ধতি চালু করবো। পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, অযাচিত হস্তক্ষেপ ঠেকাতে এবং চলমান উন্নয়ন পক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত করতে ফাইল চালাচালিতে সময় নষ্ট প্রতিরোধে ডিজিটাল পদ্ধতির এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ক্রয় ব্যবস্থায় ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) কার্যক্রম চালু হলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানায়, বেশিরভাগ প্রকল্পের ডিপিপি পাওয়ার পরে তা সঠিক বিবেচিত হলে তা কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু প্রচলিত অবস্থায় কাগুজে ফাইল দুই দফা আনা-নেওয়া করতে এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততার কারণে তা অনুমোদন করে ফিরে আসতে প্রকল্পের মূল সময় থেকে ৬ মাস ক্ষেত্র বিশেষে এক বছর চলে যায়। পরবর্তীতে অনুমোদিত একটি প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হয় না। এতে নতুন করে সংশোধনী আনতে হয়। এতে করে একদিকে উন্নয়নে ধীরগতি আসছে অন্যদিকে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তারা সরকারি অর্থ অপচয় করছেন। উন্নয়ন প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তৃণমূলে দৃশ্যমান উন্নয়নের লক্ষ্যে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) কর্মকর্তারা জানান, সরকারের জাতীয় ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পোর্টাল (http://eprocure.gov.bd) তৈরি করা হয়েছে। ই-জিপি সিস্টেমটি সরকারের ক্রয়কারী সংস্থা (পিএ) এবং ক্রয়কারী (পিই)-সমূহের ক্রয়কার্য সম্পাদনের জন্য একটি অনলাইন প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের ক্রয়াদেশের অনুমোদন দেয়া হবে। কর্মকর্তারা আরো জানান, ই-জিপি একমাত্র ওয়েব পোর্টাল যেখান থেকে এবং যার মাধ্যমে ক্রয়কারী সংস্থা এবং ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরাপদ ওয়েব ড্যাসবোর্ডের মাধ্যমে ক্রয়-সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করতে পারবে। ই-জিপি সিস্টেম সিপিটিইউতে স্থাপিত ডাটা সেন্টারে ধারণ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে সরকারের ক্রয়কারী সংস্থা এবং ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ই-জিপি ওয়েব পোর্টালে প্রবেশ করতে পারবে। এই পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হবে। এর মাধ্যমে সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় দরদাতাগণের অবাধ অংশগ্রহণ ও সমসুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়াও ক্রয় প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।সূত্রমতে, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬-এর ধারা ৬৭ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি-১২৮ অনুসরণে প্রণীত এবং জারিকৃত ‘ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) নির্দেশমালা’ মেনে সরকারি তহবিলের অর্থ দ্বারা যে কোন পণ্য, কার্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে ই-জিপি পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে। এ জন্য ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। সূত্রমতে, টেন্ডারে সংঘাত সংঘর্ষ এবং রক্তক্ষয় ঠেকাতে ২০১১ সালে ই-জিপি বাস্তবায়নে একটি নতুন আইন জারি করে সরকার। এরপরে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারগুলোকে এই প্লাটফর্মের আওতায় আনা হয়। এরপরে তুলনামূলক কম সময়ে টেন্ডার বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ প্রেক্ষিত উন্নয়ন প্রকল্পের ক্রয়-সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদনের জন্যও এই প্লাটফর্মে আনা হলো। পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য জানান, বিগত অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি শতভাগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ সব পদক্ষেপের মধ্যে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণসমূহ খুঁজে বের করা হয়। এর একটি কারণ ছিল ফাইল অনুমোদনে বিলম্বে। এ প্রেক্ষিত এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পদ্ধতির সঠিক বাস্তবায়ন ও যথাযথ ব্যবহার হলে চলমান ব্যবস্থার তুলনায় অনেক সময়ক্ষেপণ কমে যাবে। যার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের সময় ও অর্থ অপচয় কমবে। প্রকল্পে তদারকি বাড়বে এবং প্রকল্পের দুর্নীতি-অনিয়মও কমে আসবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বলেন, এটি একটি ভাল উদ্যোগ। আমাদের দেশের প্রচলিত অবস্থানে এই ধরনের পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে নিঃসন্দেহে সময় কমবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি দিক থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এতে করে পরিকল্পনা কমিশন প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে খুব কম সময়ে একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠাতে পারবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও এই ধরনের ই-ফাইলিং গ্রহণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ লোকবল দরকার পড়বে। অন্যথায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জটিলতা তৈরি হতে পারে। আর উভয় দিকে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত দক্ষ লোকবল থাকলে প্রকল্পের অনেক সময় কমে যাবে।