গত ১৬ জুলাই, ২০১৫ ‘সাংবাদিক সহায়তা ভাতা ও অনুদান প্রদান’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে দেশের উন্নয়ন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে সাংবাদিকদের লক্ষ রাখা উচিত। একই সঙ্গে অপসাংবাদিকতা ঠেকাতে সাংবাদিক নেতাদের প্রতি তিনি আান জানান। সরকারের কার্যক্রম নিয়ে সাংবাদিকদের গঠনমূলক সমালোচনা যত হোক, তাতে সরকারের কোনো আপত্তি নেই। কারণ সমালোচনা বেশি হলে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়; সেখান থেকে জানতে পারা যায় কোনো কাজটা ভালো হচ্ছে, আর কোনো কাজটা মন্দ হচ্ছে, সেটা দেখার একটা সুযোগ হয়। অর্থাৎ দেশের উন্নয়নে শেখ হাসিনার নিরলস প্রয়াস অব্যাহত রাখার দৃঢ় সংকল্প সেদিন ব্যক্ত হয়েছে। এ কথা সত্য গত সাড়ে ছয় বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচারের চেয়ে অপপ্রচার বেশি হয়েছে। এমনকি সরকারের প্রচার সেলের দুর্বলতাকে কোনো কোনো সময় সেই দায় বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা এখন বিস্ময় সৃষ্টি করেছে তাবৎ দুনিয়ার কাছে।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য। বিশ্বের ৭৬তম ধনী রাষ্ট্র এটি। বিশ্বের ১১তম সুখী দেশের তালিকায়ও আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ৬ষ্ঠতম ভাষা হিসেবে বাংলা অনেক আগে থেকে স্বীকৃত। আমরাই একমাত্র ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। অন্যদিকে বাংলাদেশ শক্তিশালী ১০টি মুসলিম দেশের একটি। এখানে (কক্সবাজারে) রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় লোনাপানির ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন এখানে অবস্থিত। বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতু হচ্ছে বঙ্গবন্ধু সেতু। পদ্মা সেতুর কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি সৈন্য প্রেরণ করেছে বাংলাদেশ। এ দেশটি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে ২৭তম, গার্মেন্টস শিল্পে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ দেশটি ২০৫০ সালে বিশ্বের অন্যতম ১০টি ক্ষমতাধর দেশের একটিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করে এদেশ চলতি বছর (২০১৫) পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যাচ্ছে।
আসলেই লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এবং ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার ইতিহাসই আমাদের গৌরবান্বিত করেছে। আমরা এ দেশ নিয়ে গর্ব করতেই পারি। আর এ গৌরব অর্জনে যে দলটির সবচেয়ে বেশি অবদান সেটি হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। সবাই এক কথায় স্বীকার করবেন যে, আওয়ামী লীগ একটি সংগ্রামী রাজনৈতিক সংগঠন। এই দলের অভ্যুদয়ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই দলের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দ্বারা প্রমাণ করেছে যে দলটি জনগণের মঙ্গল চিন্তা করে। কারণ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান অনুসরণ করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে দলীয় আদর্শের চেয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা গুরুত্ববহ। এ জন্য আওয়ামী লীগ তার উদ্দেশ্য ও আদর্শের বাস্তবায়নে যেমন নির্বাচনে অংশ নিয়ে এগিয়ে চলেছে তেমনি জনগণের সংকট মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করছে। কেবল নির্বাচনে অংশ নিয়ে নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জন বিপুল। কারণ এ দলটি জনগণের সংগঠন। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠনের অন্যতম এ দল। আওয়ামী লীগ দেশপ্রেমিক সংগ্রামী, প্রতিবাদী, নির্ভীক ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবমান। উদার জাতীয়তাবাদের আদর্শের কারণে আওয়ামী লীগ অসা¤প্রদায়িক, সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রণীত অর্থনীতিতে বিশ্বাসী সংগঠন। এ কারণেই সংগঠন ও সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার সময় মিডিয়াকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বর্তমান সরকারের চেতনা ধারার উল্টো মেরুতে অবস্থান করছে বিএনপি-জামায়াত।
বিএনপি-জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বিরোধী। এ জন্য জনগণকে জিম্মি করে তারা দফায় দফা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চালিয়ে এখন হাল ছেড়ে ঘরে বসে আছে। কিছুদিন আগে সরকার পতনের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া জামায়াত-বিএনপি যে কোনো সময় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে পারে বলেও গোপন সংবাদ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মূলত একটি দলের নেতা খালেদা জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন করবেন এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আক্রমণাত্মক জবাব দেবেন এই বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া গেছে ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখের ঘটনায়। তিনি নিজের ডাকা কর্মসূচিতে যোগ দিতে না পেরে যেসব কথা বলেছেন এবং উষ্মা প্রকাশ করেছেন তাতে তার দলীয় অপমনোবৃত্তি প্রকাশ পেয়েছে। যদিও পূর্বেই সারা দেশবাসী জেনেছিল ‘ঢাকা অভিযাত্রা’র অনুমতি মেলেনি এবং তিনি নিজে বাড়ি থেকে বের হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি তবু তার মন্তব্যগুলো আমাদের জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছিল। বিএনপি জনগণের মুক্তি চায়, দেশ বাঁচাতে চায়- এসব তাহলে কথার কথা? গত কয়েক বছর ১ সেপ্টেম্বরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশের সুধী সমাজ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিএনপি নামক দলটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠার (১৯৭৮) পর গত ৩৬ বছরে এর নেতাকর্মীদের অপতৎপরতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, বিএনপি মানে নাশকতা, বিএনপি মানে অরাজকতা। স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার দক্ষতা তাদের মধ্যেই দেখা গেছে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। বরং দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে এ দেশের সেনাবাহিনীতে চলছিল অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের পালা। সেই পটভূমিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। প্রথমে তিনি ১৯ দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দল গঠনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বেই বিএনপির জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া নেতৃত্বশূন্য রাজনীতির মাঠে আবির্ভূত হয়ে দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে মূল নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেন। ভিন্ন ভিন্ন মতের রাজনীতিক জড়ো করে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বলেই দলটির আদর্শ একটি গুবলেটে পরিণত হয়। তারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শকে গ্রহণ করে এগিয়ে গেলেও সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের স্থান থাকায় দলীয় আদর্শ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ভারতবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করে প্রথম থেকেই বিএনপি পাকিস্তান ঘরানার মতাদর্শ প্রচারে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে পরবর্তী সময় স্বাধীনতার ঘোষকে পরিণত হওয়া জিয়ার জন্য ছিল অনিবার্য। কারণ পাকিস্তানি মতাদর্শ বিএনপির মজ্জাগত আদর্শ বলে গণ্য হয়। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জিয়ার পতাকাতলে সেদিন ইসলামপন্থি, বামপন্থি ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি সমবেত হয়েছিল। তারাই এ দেশের ইতিহাসকে আওয়ামী লীগের আদর্শের বিপরীতে প্রবাহিত করার সুযোগ পায়। সাংবাদিকরা বিএনপির এই ইতিহাস স্মরণে রাখলে বর্তমান সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করতে আরো বেশি উৎসাহী হবেন।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা এক আশ্চর্য সাহসী রাজনীতিকের নাম; যাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে চলেছে। তাছাড়া শেখ হাসিনাবিহীন যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াতকে। আবার নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার বীভৎস চিত্র গণমানুষকে আতঙ্কিত করে তোলায় তারা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতায় সন্তোষ প্রকাশ করে। এদিক থেকে ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিএনপির অবরোধ-হরতাল-নাশকতার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ২০১৫ সাল ২০১৪-এর মতোই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু সহিংসতা আর জ্বালাও-পোড়াও করে অতীতে তারা থামাতে পারেনি যুদ্ধাপরাধের বিচার। বরং কুখ্যাত সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় জনগণকে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল করে তুলেছে অনেক বেশি। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে জামায়াতের বাঁচা-মরার আন্দোলনও দমে গেছে। শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, ক‚টনৈতিক দিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সব বিরূপ পরিস্থিতিকে নিজের অনুক‚লে নিয়ে এসেছেন। তার মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা। কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীদার বানিয়ে ফেলেছেন রাশিয়া ও জাপানকে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধুত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়েছে। পূর্বমুখী ক‚টনীতির অংশ হিসেবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। নিজের সরকারের উন্নয়নের মডেল অন্যান্য দেশের কাছে উপস্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছেন।
মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা এক সময় ভাবতে শুরু করেছিল এই দলটি ব্যর্থ, কোনোকিছু গুছাতে পারছে না তারা এখন বলতে শুরু করেছে সাহসী দল হিসেবে এবং নির্ভীক নেতারূপে শেখ হাসিনাই এ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম। অন্যদিকে বর্তমানে আন্দোলন গড়ে তোলা, সরকার উৎখাত করা বা অন্য কিছু করার মতো ইস্যু ও সাংগঠনিক শক্তি বিএনপি ও জামায়াত কারো নেই। এমতাবস্থায় মিথ্যা কথার প্রচার-প্রচারণা আর নানা কর্মসূচি দিয়ে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নেয়ার অপপ্রয়াস বিএনপি-জামায়াতের জন্য স্বাভাবিক। তবে মানুষ হত্যার রাজনীতি পরিহার করে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠনমূলক রাজনীতি শুরু করা জরুরি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনায় সহায়তা করা দরকার। কারণ আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশকে বিশ্বসভার মধ্যমণিতে আসীন করার জন্য। সফল বাংলাদেশ দেখতে হলে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই- মিডিয়াকে সে কথা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে।
মিল্টন বিশ্বাস : সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।