স্বরূপে ফিরছে শিল্পনগরী

স্বরূপে ফিরছে শিল্পনগরী খ্যাত খুলনা। গত ১০ বছরে এই এলাকায় জুটমিলসহ অন্তত ৩০টি ভারী ও মাঝারি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। নগরীর আশপাশে গড়ে উঠছে আরও নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় ব্যক্তিমালিকানায় কলকারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানায় ২০ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আরো বেশ কয়েকটি কারখানা নির্মাণাধীন রয়েছে। সেগুলো চালু হলে আরো কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

শিল্প মালিকরা ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগেও ফুলতলা ও পাশের অভয়নগর এলাকা ছিলো সন্ত্রাস কবলিত। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা সেখানে কোন কলকারখানা স্থাপন করতে সাহস পেতেন না। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে।

সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওই এলাকায় ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠা কলকারখানায় এখন শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মচঞ্চলতা। উত্পাদন শুরু হওয়া মিল-কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে সুপার জুটমিল, তিতাস সল্ট, মধুমতি সল্ট, পদ্মা সল্ট, পান পাতা মিশ্র সার কারখানা ইত্যাদি। দেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপও অভয়নগরের পাশাপাশি ফুলতলায়ও জমি কিনেছে নতুন শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য। ইতিমধ্যে তারা নওয়াপাড়ায় একটি বড় আকারের জুট মিল স্থাপন করেছে। সেখানে প্রায় ২ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফুলতলায় প্রস্তুতি চলছে আরো একটি নতুন জুটমিল স্থাপনের।

এছাড়া খুলনা ও নওয়াপাড়া এলাকায় আরো অন্তত ৬টি জুটমিল নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে চালু হওয়া সুপার জুটমিলে দৈনিক ৬০ টন সুতা উত্পাদন হচ্ছে। শতভাগ রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে চালু হওয়া এ মিলে প্রায় ১ হাজার ৫শ’ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পুরোপুরি উত্পাদনে গেলে এ মিলে আরো প্রায় ১ হাজার লোক কাজ করতে পারবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

সুপার জুটমিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, শিক্ষিত হয়ে বেকার থাকলে তাদের মধ্যে হতাশা এবং হিংস্রতা বাড়বে। উদ্যোক্তারা এখানে তুলনামূলক অল্প মূল্যে জমি এবং শ্রমিক পাচ্ছেন। এটা বিনিয়োগের একটা বড় ইতিবাচক দিক। তিনি আশা প্রকাশ করেন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া যাবে।

অন্যদিকে গত ৫ বছরে খুলনার বন্ধ হয়ে যাওয়া পিপলস জুটমিল, দৌলতপুর জুটমিল, আলীম জুটমিল সরকারের উদ্যোগে পুনরায় রাষ্ট্রায়ত্ত মিল হিসাবে চালু করা হয়েছে। নতুন কলকারখানা নির্মাণ এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো পুনরায় চালু হওয়ার ফলে খুলনা ও সংলগ্ন শিল্প এলাকায় কর্মচঞ্চলতা ফিরে এসেছে। ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা, কাঁচামালের সহজলভ্যতা এবং কমদামে শ্রমিক পাওয়ার সুবিধার কারণে গেল শতকের মাঝামাঝি থেকেই খুলনায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। এর মধ্যে দেশের একমাত্র নিউজপ্রিন্ট মিল, শিপইয়ার্ড, মত্স্য (চিংড়ি) প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, হার্ডবোর্ড মিল, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরীসহ অনেকগুলো পাটকল নির্মিত হয়। খুলনা ছাড়াও দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চল থেকে মানুষ কাজের সন্ধানে এখানে আসে।

খুলনায় এতগুলো পাটকল নির্মিত হওয়ার পর উত্পাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি জন্য প্রায় ঐ একই সময়ে (পঞ্চাশের দশক) গড়ে ওঠে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মংলা সমুদ্র বন্দর। মংলা বন্দর গড়ে ওঠার মূল কারণও ছিল খুলনার শিল্পকারখানায় উত্পাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা। এক পর্যায়ে অনেক মিলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মংলা বন্দরে জাহাজ আগমনের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। কাজ না থাকায় মংলা বন্দরের শ্রমিক কর্মচারীরাও বেকার হয়ে পড়েন। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো পুনরায় চালু হওয়ায় এবং ব্যক্তি মালিকানায় অনেকগুলো পাটকল নির্মিত হওয়ার কারণে মংলা বন্দরে গত দুই বছর ধরে জাহাজ আগমনের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুলনার মত মংলাও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে।

এদিকে আশির দশকে খুলনা এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়। অল্প পুঁজি খাটিয়ে ৪/৫ মাসের মধ্যে অধিক লাভ হওয়ায় এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে আসে। চিংড়ি চাষে অনেক বেশি লাভ হয় বলে এই এলাকায় মানুষ উত্পাদিত চিংড়িকে ’সাদা সোনা’ বলে অভিহিত করে থাকে। প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে বৃহত্তর খুলনায় চিংড়ি চাষ হয়। এলাকার বেশিরভাগ জমি মালিক জমিতে ধান চাষ বন্ধ করে দিয়ে চিংড়ি চাষ করার কারণে ফসলি জমির পরিমাণ কমতে থাকে।

খুলনা উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি শরীফ শফিকুল হামিদ চন্দন ইত্তেফাককে বলেন, বিগত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে খুলনার নিউজ প্রিন্ট মিল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির মত অনেকগুলো ভারী ও মাঝারি শিল্পকারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমান সরকার নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী খুলনার অনেকগুলো বন্ধ শিল্পকারখানা পুনরায় চালু করে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় খুলনা এলাকার সাধারণ মানুষ এখন আর্থ-সামাজিক দিক থেকে ভাল আছেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) সমাজ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান ও সামাজিক বিজ্ঞান স্কুলের ডিন প্রফেসর ড. মো. আব্দুল জব্বার ইত্তেফাককে বলেন, গত ১২ বছরের মধ্যে খুলনা অঞ্চলে প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, এক যুগ আগে খুলনার নিরালা এলাকায় যতগুলো ভবন ছিল এখন সেখানে অন্তত ৫ গুণ বেশি ভবন নির্মিত হয়েছে। রাস্তাঘাট আগের চেয়ে অনেক প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন হয়েছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১২ বছর আগে তিনি ১০ টাকা দিয়ে রিকশায় যে পথ যেতেন এখন সেখানে যেতে হলে অন্তত ৪০ টাকা লাগে। তাছাড়া অপরাধ প্রবণতা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। আগে খুলনায় এরশাদ শিকদারের মত ছোট-বড় গডফাদাররা ছিল। এখন ওই ধরনের কোন অপরাধী আর তৈরি হচ্ছে না।

খুবি’র অর্থনীতি ডিসিপ্লিন প্রধান প্রফেসর মোহাম্মদ জিয়াউল হায়দার বলেন, যেকোন সূচকেই খুলনার মানুষের জীবন-যাত্রার মান আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বছর বিশেক আগে খুলনায় হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ছিল। এখন সেখানে ব্যক্তি মালিকানায় অনেকগুলো পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেবল পাটকলই নয়, মিশ্র সার কারখানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, মত্স্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, লবণ ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন ভারী মাঝারি ও ছোট-খাটো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে এখানে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি অনেকগুলো প্রাইভেট ব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেখানেও মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। তিনি বলেন, দশ বছর আগে খুলনা শহরে যে কয়টা প্রাইভেট কার রাস্তায় দেখা যেত বর্তমানে তার তুলনায় অনেকগুণ বেশি গাড়ি রাস্তায় দেখা যায়। নগরীতে বিভিন্ন ধরনের বিপণী বিতান ও সেখানে ক্রেতাদের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তালুকদার খালেক এমপি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পর পর দুইবার ক্ষমতায় থাকার করণে খুলনা অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে রূপসা ব্রিজ (হযরত খানজাহান (র.) সেতু) নির্মাণ। এই ব্রিজ নির্মিত হওয়ার ফলে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে খুলনার যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ, শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মিত হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্ধ জুটমিলগুলোকে একে একে পুনরায় রাষ্ট্রায়ত্ত মিল হিসাবে চালু করা হয়েছে। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে খুলনায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মংলা বন্দরকে আরো গতিশীল করতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন করা হয়েছে। রামপালের হযরত খান জাহান (র.) বিমান বন্দরের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া খুব শিগগিরই শুরু হচ্ছে। এ বিমান বন্দর চালু হলে খুলনাসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চেহারাই পল্টে যাবে বলে তালুকদার খালেক জানান।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার (কেএমপি) নিভাস চন্দ্র মাঝি জানান, তার ৮টি থানা এলাকায় আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকার পরিস্থিতি এখন ভাল। কোথাও কোন ঘটনা ঘটলে খবর পাওয়ার সাথে সাথে ঘটনাস্থলে গিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুস সামাদ ইত্তেফাককে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে খুলনায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসব কাজ হচ্ছে। ইতোমধ্যে মংলা বন্দরের ড্রেজিং কাজ সমাপ্ত, ঘষিয়াখালি চ্যানেলের পুনঃখনন, গ্রামীণ সড়ক ও মহাসড়কের সংস্কার প্রভৃতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আরো ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণ, খানজাহান আলী (র.) বিমান বন্দরের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা, উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব কাজ সম্পন্ন হলে খুলনার সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।