এবার সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ সম্মেলন ॥ উর্বর ভূমি বাংলাদেশ

এম শাহজাহান ॥ বিনিয়োগের জন্য এক উর্বর ভূমির নাম বাংলাদেশ। এই বার্তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে এবার সিঙ্গাপুরে বসছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন সব দেশের বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা মিলিত হবেন এ সম্মেলনে। সম্মেলনে বাংলাদেশের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে বিনিয়োগের আহ্বান করা হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে আগামী ২৭ আগস্ট এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৫০ জন বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা এতে অংশগ্রহণ করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ১৫টি সেবামূলক খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে ১৭টি খাতে। এছাড়া বিনিয়োগ করার পর সেই বিনিয়োগ সুরক্ষায় বিশ্বের ২২তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ আনতে ইতোমধ্যে শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
এছাড়া অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে গত কয়েক বছরে দেশে সরকারী বিনিয়োগ কয়েকগুণ বেড়েছে। এ কারণে বেড়েছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগও। মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ক্রয় ক্ষমতা। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশই এখন একটি বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। বেড়েছে দেশের রফতানি খাতের সক্ষমতাও। ফলে দেশে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর তাই যৌথভাবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন নামের অনুষ্ঠানের এ আয়োজন করেছে সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন ও মাইডাস টাচ এশিয়া (এমটিএ)। তৃতীয়বারের মতো এ সম্মেলন শতভাগ সফল করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনটি সফল করতে এবার একটি বড় পরিসরে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি রয়েছে। বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ যে খুব ভাল একটি দেশ এই বার্তা আমরা বিনিয়োগকারীদের দিতে চাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিবাচক দিকগুলো সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হবে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বেড়েছে ক্রয় ক্ষমতা, এ বাস্তবতায় বাংলাদেশও এখন একটি বড় বাজার। আমাদের চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে পূরণ করতে হচ্ছে।
তবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এদেশে বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারেন। শুধু তাই নয়, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে। চলতি বাজেটেও এই বিষয়ে অনেকগুলো পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ইতোমধ্যে জাপান, ভারত, চীন ও কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এসব দেশের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশও বিনিয়োগের এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। আর এজন্যই বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের এ আয়োজন।
জানা গেছে, দিনব্যাপী এ বিনিয়োগ সম্মেলনে এশিয়ার ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও রেটিং এজেন্সি বা ঋণমান নির্ণয়কারীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় আড়াইশ বেশি প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। এতে সরকারী কর্মকর্তা এবং কয়েকটি ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সম্মেলনে সমাপনী ভাষণ দেবেন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বাংলাদেশের বিনিয়োগের সুযোগ, পণ্য রফতানিতে বৈচিত্র্য, শেয়ারবাজার, পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্পোরেট বাজার নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করছে সরকার। বিশেষ করে জমির স্বল্পতার কথা বিবেচনায় নিয়ে সেবা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কাজ করা হচ্ছে। এ সব খাতে বিনিয়োগের জন্য জমির খুব প্রয়োজন হয় না। বিষয়টি নিয়ে বিনিয়োগ বোর্ড কাজ করছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের সঙ্গে কর্মসংস্থানের যোগসূত্র রয়েছে। তাই বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে ভারি ও বৃহত শিল্পকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এটি সরকারের এটি ভাল উদ্যোগ। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আনা নয়, বরং বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একটি জায়গায় হাজির করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। সে জন্য এই সম্মেলনটিকে একটি প্লাটফর্ম বলা যায়।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর দৌড়ঝাঁপ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জঙ্গীবাদ নির্মূলে সরকারের কঠোর অবস্থান, সরকারের উদার বিনিয়োগ নীতি গ্রহণ এবং সস্তা শ্রমবাজারের কারণে ১৬ কোটি মানুষের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার এবং এশিয়া অঞ্চলের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বাজারে প্রবেশাধিকারের সুযোগ বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের জন্য এক স্বপ্নের ভুবন। এ কারণে গত অর্থবছরে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে, যার প্রবৃদ্ধির হার ৩৭ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিরাট সম্ভাবনা আছে। রফতানিতে সুযোগ আছে। দেশের অভ্যন্তরেও আছে বিশাল বাজার। গত কয়েক বছরে ৫-৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্য ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ। এখন বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ইতিবাচক এ দিকগুলো তুলে ধরতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সব সময়ই জানতে চান, প্রশাসনে স্বচ্ছতা আছে কিনা, দেশের অভ্যন্তরের বাজার কত বড়, জমি পাওয়া যায় কিনা, সরকারের কোন কোন দফতরে ঘুরতে হয় ইত্যাদি। সম্মেলনের বিভিন্ন পর্বে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনার পাশাপাশি এ বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হবে।
জানা গেছে, মোবাইল ফোনের পাশাপাশি টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্য, রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিভিত্তিক শিল্প, কাঁচা পাট, কাগজ, রেশম শিল্প, হিমায়িত খাদ্য (বিশেষত চিংড়ি), পর্যটন, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিং এর মতো রফতানিমুখী শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ভারি ও তথ্যপ্রযুক্তির শিল্প প্রতিষ্ঠায়ও বিদেশী বিনিয়োগকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে যা দেশীয় আমদানি ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে।
ইতোমধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাতে (ইপিজেড) যৌথ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব জোনে বিদেশী বিনিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত রাখা হবে।