বিশ্বব্যাংক পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের প্রতি অবিচার করেছে। মামলার এক আসামিকে দায়মুক্তির আশ্বাস দিয়ে অভিযোগ সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা করতে সক্ষম হয়নি। এ কথা জানিয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ও এ বিষয়ক দুদকের মামলার প্রধান কৌঁসুলি ও ওই সময়ের দুদকের প্রধান আইন উপদেষ্টা বলেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এর তদন্ত করেছি। তাদের অভিযোগের কোনো সত্যতা পাইনি। বিশ্বব্যাংকও কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা মিথ্যা অভিযোগ করেছে।
আনিুসল হক বলেন, বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অভিযোগ করার পর বিপাকে পড়ে যায়। সেই অভিযোগ তারা পরে সত্য প্রমাণের জন্য ও নিজেদের ইমেজ রক্ষায় ঘৃণ্যতম কাজও করে। আমরা দুদকের মামলায় যে সাতজনকে আসামি করেছিলাম তাদের একজনকে বিদেশে নিয়ে যায়। নিয়ে তাকে প্রস্তাব দেয়, আপনি এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করবেন। বিনিময়ে আপনাকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে। আপনার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। আরও প্রস্তাব দেয় কার বিরুদ্ধে কী কী বলতে হবে। ওই সব কথাও তাকে বলতে বলা হয়। বিনিময়ে তাকে আরও কিছু সুবিধাও দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলতে রাজি হননি।
আইনমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক চারজন ব্যক্তির দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে। কিন্তু তারা শুরুতে বুঝতে পারেনি সেটা ঠিক নয়। কিন্তু পরে তারা যখন দেখল এই অভিযোগ দুদকের অনুসন্ধানে সত্য বের হয়নি তখন তারা এটা প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এ কারণ তারা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। মিথ্যা অভিযোগ করে তারা বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট করেছে। অবিচার করেছে। এরপরও তারা ওই মিথ্যাটাকেই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। বিশ্বব্যাংক চেয়েছিল তারা আমাদের দিয়ে চাপ তৈরি করিয়ে দুই আবুলসহ একটি মামলা করাবে। ওই মামলা করার পর তারা এই মামলার রেফারেন্স দিয়ে এমন কিছু কাজ করবে, যাতে তাদের অবস্থান ঠিক থাকে। প্রয়োজন হলে তারাও একটি পাল্টা মামলা করবে। কিন্তু সেটা তারা করতে পারেনি। তাদের সেই উদ্দেশ্য আমরা সফল হতে দিইনি।
বিশ্বব্যাংক আমাদের যেমন প্রমাণ দিতে পারেনি, এখন কানাডার আদালতেও কোনো প্রমাণ দিতে পারবে না। এ কারণে তারা সেখানে কোনো নথিপত্র দেবে না। সেটা দেওয়ার মতো কোনো কিছু তাদের হাতে নেই। তারা জানে যে কোনো নথি দিলে তারা যে অভিযোগ করেছিল সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। নিজেদের আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্য এখন তারা দায়মুক্তি পায় সেই যুক্তি তুলে ধরছে। তাদের সেই যুক্তি কানাডার আদালত মেনে না নিলে তাদের কিছু না কিছু দিতে হবে। আর এতেই বিশ্বব্যাংকের আসল উদ্দেশ্য বের হবে। সেটা যাতে না হয় সেই চেষ্টা করার কারণেই আদালতে নথি উপস্থাপন করতে চায় না।
তিনি বলেন, তারা মিথ্যা অভিযোগ করে আমাদের ইমেজ নষ্ট করেছে। এবার তাদেরটা হবে। তাদের মতো একটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ও শোনা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এমন অভিযোগ করল আমরা সেটাই মেনে নিতে পারি না। বিশ্বব্যাংক কেবল মিথ্যা অভিযোগ করে অবিচার করেছে তাই নয়, তাদের কারণে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন ২০১৮ সালে শেষ হচ্ছে। দুই বছর সময় পিছিয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে অনেক। এই ক্ষতি বড় ক্ষতি।
এই ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ চাইবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। ক্ষতিপূরণ চাইতে হবে কেবল ইমেজ নষ্ট করা ও মিথ্যা অভিযোগ করেছে সেটা নিয়ে। কারণ আমরা তাদের কাছ থেকে লোন নিতে চেয়েছিলাম। আর লোন নিতে চাওয়ার কারণে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না। এই বিষয়টি আমরা বিবেচনা করছি।
বিশ্ববাংকের মিথ্যা অভিযোগ করার জন্য ক্ষমা চাওয়া কিংবা অনুশোচনা প্রকাশ করা উচিত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষমা তো তাদের চাইতেই হবে। সেটা এখনই কিনা তা বলতে পারছি না। ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়েও কিংবা কেবল অনুশোচনার মধ্য দিয়ে এ অপরাধের ক্ষমা হবে না। দুই আবুলের ব্যাপারে মামলা করার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের চাপ ছিল এটাকে কেমন করে ব্যাখ্যা করবেন এ ব্যাপারে তিনি বলেন, এগুলো সবই ছিল বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সত্য প্রমাণ করার জন্য। তারা মনে করেছিল মন্ত্রী জড়িয়ে নিতে পারলে তাদের সুবিধা হবে। কানাডার আদালতে এখন যাই প্রমাণ হোক না কেন সেটা আমাদের এখানে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ আমরা ওই মামলার তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছি। আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার পর আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে। এই কারণে অন্য আদালতে এটা যাই হোক না কেন এখানে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।
বিশ্বব্যাংকের সামনে এখন দুই পথ। এক হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে তারা যে অভিযোগ করেছিল এর প্রমাণ কানাডার আদালতে নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করা। আর না হলে তাদের ভুল স্বীকার করে এরপর তাদের বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর সেটা করলে বাংলাদেশের তারা যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তার মাসুল না পেলেও জনগণের মধ্যে যে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল সেটা দূর হবে। এই অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
দুদকের কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, বিশ্বব্যাংক যা করেছে এটা বলার মতো নয়। তাদের ওই অভিযোগ কোনোভাবেই সত্য ছিল না। আমরা তদন্ত করে আমাদের রিপোর্ট দিয়েছি। এরপর মামলাটি ফাইনাল রিপোর্টের মধ্য দিয়ে নথিভুক্ত হয়েছে। কখনো এই মামলা নিয়ে কিছু হবে না। যদি কানাডার আদালতে বিশ্বব্যাংক কোনো প্রমাণ দিতে পারে, তাও না। কারণ কোনো প্রমাণ নেই। আমরা নিশ্চিত এই কারণে তারা তাদের অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। আমরা অনেক বার চেয়েছি। কিন্তু আমাদেরই যেটা দিতে পারেনি সেটা কানাডায় কেমন করে দেবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ করে তা এখনো কোথাও প্রমাণ হয়নি। দুদকও ওই মামলার শেষ করে দিয়েছে। তা হলেও এই ব্যাপারে কিছু করা দরকার ছিল। কারণ এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের কাছে সরকারের তরফ থেকে কৈফিয়ত চাওয়ার দরকার ছিল ও ক্ষতিপূরণও চাওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল, বাংলাদেশ সেটা নেয়নি। আমি মনে করি এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ওপর চাপও তৈরি করা প্রয়োজন। তারা মিথ্যা অভিযোগ করেছে এটা প্রমাণ করা দরকার। কারণ দুদক মামলাটি শেষ করে দেওয়ার কারণে একটা প্রশ্ন রয়েই গেছে। সেই প্রশ্নের নিরসন প্রয়োজন।
সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাংকের উচিত হবে বাংলাদেশের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ও গোটা জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। ক্ষতিপূরণও দেওয়া দরকার। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট আমার কাছে অনুতপ্ত হয়েছেন।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, বিশ্বব্যাংককে তো তাদের ভুলের জন্য ও মিথ্যা অভিযোগের জন্য ক্ষমা চাইতেই হবে। তারা যে কাজটি করেছে তা অমার্জনীয়। আমরা আগামীতে তাদের ব্যাপারে করণীয় বিষয় ঠিক করব। বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে পদ্মা সেতু প্রকল্পে এসএনসি লাভালিনকে পরামর্শক নিয়োগে দুদকের কাছে দুর্নীতির অভিযোগ করলেও তাদের দেওয়া কোনো নথিপত্র আদালতে উপস্থাপন না করার শর্ত দিয়েছিল। কানাডায় এখন বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে অভিযোগের প্রমাণ দিতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে দুদকের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ করলেও বারবার প্রমাণ চাইলেও বিশ্বব্যাংক সেটা দেয়নি। তারা প্রমাণ দিলে আমাদের তদন্ত করতে অনেক সহজ হতো। সময়ও কম লাগত। কিন্তু তারা অভিযোগ করে দুদককে চাপের মুখে রাখার চেষ্টা করে। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কোনোটাই তাদের মনোপূত হয়নি এই অভিযোগ করে। পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান করার জন্য মত দেয়। ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার বন্ধু আবুল হাসান চৌধুরীকে অভিযুক্ত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।
সূত্র জানায়, কানাডার আদালতে নথি দিতেও বিশ্বব্যাংক এবারো গড়িমসি করছে। তারা কোনো প্রমাণ দিতে চাইছে না। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক কী করবে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কানাডায় মামলার আদালতে পরবর্তী শুনানির দিনের জন্য।
জানা গেছে, সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের তদন্তে পাওয়া তথ্যের নথিপত্র আদালতে উপস্থাপনের দাবি জানান জুলফিকার ভূইয়ার আইনজীবী। এজন্য আদালত বিশ্বব্যাংককে তথ্যপ্রমাণ দিতে বলে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আদালতের শুনানিতে অংশ নেবে না বলে জানায়। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাংক আইনি দায়মুক্তি ভোগ করে। এ কারণে তাদের কোনো নথিপত্র কোনো আদালতে জমা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য নয়। কানাডার আইনও এই দায়মুক্তি দিয়েছে সংস্থাটিকে। এই যুক্তিতে তারা আদালতে নথি দিতে চাইছে না। তারা এ দাবি করলেও অন্টারিওর সুপারিয়র কোর্ট অব জাস্টিসের বিচারক আদেশে বলেছেন, আরসিএমপির তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এ কারণে বিশ্বব্যাংক নিজেই দায়মুক্তির লঙ্ঘন ঘটিয়েছে। আদালতের বিচারক বলেছেন, কানাডার আইন এমনিতেই পুলিশের স্পর্শকাতর সোর্সের গোপনীয়তার সুরক্ষা করে। বিশ্বব্যাংকের চারজন তথ্যদাতার মধ্যে দুজনকে আদালত গোপনীয় তথ্যদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণে আসামিকে দায়মুক্তির প্রস্তাব দেয় বিশ্বব্যাংক
পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি প্রসঙ্গে আনিসুল হক