প্রথমবারের মতো একটি সমন্বিত বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, সে লক্ষ্যে এটি তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। শিগগিরই ফোকাল কমিটি এটি যাচাই করবে। এর পর তা চূড়ান্ত হবে।
খসড়া বাণিজ্যনীতিতে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে রফতানি বৃদ্ধি ও বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের ওপর। এছাড়া নতুন নতুন গন্তব্যে পণ্য রফতানি ও রফতানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
বাণিজ্যনীতির খসড়ায় বলা হয়, আমদানির ক্রমবর্ধমান খরচ মেটাতে ও ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঠিক রাখতে বাংলাদেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্স ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক সেবা রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। মোট রফতানির মাত্র ১০ শতাংশ এ খাতের। সেবা খাতের বাণিজ্যে বাংলাদেশ খুবই হতাশাজনক অবস্থায় রয়েছে। ভিশন ২০২১ অর্জন করতে হলে সেবা খাতের উন্নয়ন জরুরি। শুধু রেমিট্যান্স আনলেই হবে না, নতুন নতুন সেবা রফতানিতেও জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে কল সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা ও পর্যটন।
তৈরি পোশাক শিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করা জরুরি বলে বাণিজ্যনীতির খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশেষ করে এ খাতের ফরওয়ার্ড লিংকেজ, বিপণন ও নকশা প্রণয়নে জোর দিতে হবে। এতে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য রফতানির সক্ষমতাও বাড়বে।
খসড়া নীতির উদ্দেশ্যের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক উৎস থেকে আসা আয়ের বৃহদংশই আসে তৈরি পোশাক রফতানি ও প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে। রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপের বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশেষভাবে লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানি গন্তব্য আমেরিকা। কিন্তু সেখানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কোটামুক্ত সুবিধা পায়নি।
এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ খুব কম সংখ্যক পণ্য রফতানি করে। এর মধ্যে প্রধান তৈরি পোশাক। এ পণ্যের ৮৫ শতাংশই ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে রফতানি হয়। আর অন্যান্য পণ্য মিলে বাংলাদেশের মোট রফতানি বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশই ইউরোপ-আমেরিকা ঘিরে পরিচালিত। বিশ্বের অন্যান্য গন্তব্যে রফতানি হওয়া পণ্যের পরিমাণ মোট রফতানির মাত্র ২৫ শতাংশ।
এদিকে প্রতি বছর রফতানি বাড়লেও এবং রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট হলেও বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এর প্রধান কারণ অভ্যন্তরীণ ভোগের জন্য পণ্য আমদানি। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি। এর বাইরে মূলধনি যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য, টেক্সটাইল ও খাদ্যপণ্য আমদানিও বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
সমন্বিত এ বাণিজ্যনীতি প্রণয়নে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্রেড পলিসি সাপোর্ট প্রোগ্রাম (বিটিপিএসপি) প্রকল্পের অধীন এটি প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ মারাইকা মাইন এ নীতির খসড়া করেছেন। পরে এটি পর্যালোচনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছয়টি সাব-কমিটি ও একটি ফোকাল কমিটি গঠন করে। সাব-কমিটিগুলো খসড়াটি পর্যালোচনা করে তাদের মতামত ফোকাল কমিটিতে পাঠায়। ওই মতামতের আলোকে খসড়ায় পরিবর্তনের সুপারিশ করে ফোকাল কমিটি। এরই মধ্যে মারাইকা মাইনের স্থলাভিষিক্ত ক্যাটরিনা মারমাজিয়োলি প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ বাণিজ্যনীতিটি ফোকাল কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছেন। শিগগিরই এটির ওপর পর্যালোচনা (ভ্যালিডেশন) সভা অনুষ্ঠিত হবে। পরে তা মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হতে পারে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এনডিসি বলেন, সমন্বিত বাণিজ্যনীতির খসড়া প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সার্বিক বিষয় প্রস্তাবিত সমন্বিত বাণিজ্যনীতিতে উল্লেখ থাকবে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে যে নীতিমালা রয়েছে, তা বহাল থাকবে। এক্ষেত্রে সমন্বিত বাণিজ্যনীতির সঙ্গে কোনো বিষয় সাংঘর্ষিক হলে তা সংশোধন করা হবে।
এদিকে আসন্ন পর্যালোচনা সভায় প্রত্যেক সাব-কমিটিকে তাদের পূর্ববর্তী পর্যালোচনায় দাখিলকৃত মতামত এবং ওই মতামতের ভিত্তিতে খসড়া সমন্বিত বাণিজ্যনীতিটি যথাযথভাবে সংশোধিত হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে পুনরায় মতামত দিতে হবে।
সমন্বিত বাণিজ্যনীতির খসড়ায় যেসব বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো— আমদানিনীতি আদেশ, রফতানিনীতি, বাণিজ্য প্রতিরক্ষা, বিভিন্ন ধরনের সংস্কার, কাস্টমস ও সীমান্ত বিষয়, আন্তর্জাতিক পরিবহন নেটওয়ার্ক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি ও মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার নীতি, ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস সুরক্ষা, গুণগত অবকাঠামো, সরকারি কেনাকাটা, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাণিজ্য উদ্যোগ, মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি, আর্থিক নীতি ও কর কাঠামো, বাণিজ্য সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নয়ন ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব।
এছাড়া দেশের শিল্প ও এসএমই নীতি, কৃষি ও অন্যান্য খাত বিষয়ক নীতি, বিশ্ববাজারে প্রবেশগম্যতা, আঞ্চলিক বাজারে প্রবেশগম্যতা, বিদ্যমান ও সম্ভাব্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ, কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিকার, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক সুরক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন, আমদানি ও রফতানিনীতির মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়ও বাণিজ্যনীতিতে উল্লেখ থাকছে।
ভিশন ২০২১ অর্জন করতে হলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে ৩৫-৪০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন বলে নীতিতে উল্লেখ করা হয়।
সমন্বিত বাণিজ্যনীতির খসড়ায় বাংলাদেশের বাণিজ্যের কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করা হয়। দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বাধা হিসেবে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, দুর্বল অবকাঠামো, স্বচ্ছতার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আইনগত অনিরাপত্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো উচ্চমাত্রার দক্ষতা অর্জন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। নীতিতে আরো উল্লেখ করা হয়, আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কম। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য এ বিষয়গুলোয় জোর দেয়া প্রয়োজন।