জাপানের টোকিও কিংবা ফ্রান্সের প্যারিস নগরীর বুক চিরে না গিয়েও এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানো যায়। রাজধানীতে চলাচলের জন্য ওই সব নগরীতে আছে কমপক্ষে তিনটি বিকল্প পথ। বৃত্তাকার ওই সব পথ কমিয়েছে মানুষের ভোগান্তি। ঢাকায় দিনে বাড়ছে দুই হাজার নুতন মুখ। ঈদ কেনাকাটার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যোগ হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি গাড়ি। ফলে রাজধানীর পথে পথে এখন অসহনীয় যানজট। এখন ৭৩টি মোড়ে নষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন কমপক্ষে এক কোটি কর্মঘণ্টা।
তবে আশার কথা হলো, ঢাকার মধ্যস্থলে যানবাহনের চাপ কমাতে ১৫টি বিকল্প সড়কের মধ্যে এবার ১০টিই ব্যবহার করা যাবে। প্রকল্প গ্রহণের ১৪ বছর পর আজ চালু হচ্ছে আশুলিয়া-বিরুলিয়া বিকল্প মহাসড়ক। আর প্রকল্প নেওয়ার এক দশক পর বাস্তবায়ন হয়েছে রামপুরা-ডেমরা-আমুলিয়া সড়ক।
গতকাল সোমবার রাজধানী থেকে শুরু হয়েছে ঈদ যাত্রা। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চারদিকের পথেই গাড়ির চাপ বাড়ছে। গতকাল গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালে ট্র্যাফিক পুলিশ সকাল থেকেই গাড়ির চাপ সামাল দিতে বাঁশ বেঁধে আলাদা লেন তৈরি করে। পরিবহন-সংক্রান্ত এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে ৮৮ শতাংশ যাত্রীই সড়কপথ ব্যবহার করে।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও ঢাকা-টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কের স্থানে স্থানে যানজট তীব্র হয় স্বাভাবিক সময়েও। আর ঈদ যাত্রায় এই দুই সড়কে পড়ে ১০ গুণ চাপ। রাজধানীতে ঢোকা ও বের হওয়ার বিকল্প পথ হিসেবে মিরপুর-বিরুলিয়া-আশুলিয়া মহাসড়ক নির্মাণের জন্য সওজ অধিদপ্তর ২০০০ সালের ১ জুলাই প্রকল্প নিয়েছিল। ২০০৩ সালের মধ্যে ২০ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের এক যুগ পর দ্বিগুণ বেশি খরচে সেতুসহ ১০.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ মহাসড়কটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। আজ থেকেই এই পথে চলাচল করবে যানবাহন। এ মহাসড়ক ধরে যানবাহন আশুলিয়া বাজারে পৌঁছে যাবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অন্যান্যবার ঈদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও ঢাকা-টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কে যে চাপ পড়ত এবার তা হবে না।
সওজ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যানুসারে, রাজধানী থেকে উত্তরের ১৬ জেলা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতে এবার মূল সড়কের বিকল্প ১০টি সড়ক-মহাসড়ক ব্যবহার করা যাবে। এগুলোর মধ্যে যাত্রাবাড়ী-ডেমরা-সুলতানা কামাল সেতু হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচল করা যাবে। রাজধানীর বাবুবাজার ব্রিজ (বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু)-ইকুরিয়া-পোস্তগোলা ব্রিজ (বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতু) পাগলা-চাষাঢ়া-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড-সাইনবোর্ড হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল করা যাবে। মহাখালী হয়ে যে গাড়িগুলো চট্টগ্রাম যাতায়াত করবে সেগুলোর একটি বড় অংশ ব্যবহার করতে পারবে টঙ্গী স্টেশন রোড-শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার উড়াল সড়ক-মীরেরবাজার-উলুখোলা-কাঞ্চন ব্রিজ-ভুলতা-মদনপুর মহাসড়ক। বাবুবাজার ব্রিজ-ইকুরিয়া পোস্তগোলা ব্রিজ-পাগলা-চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড-সাইনবোর্ড হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে রামপুরা হয়ে নতুন তৈরি হওয়া শেখের জায়গা-আমুলিয়া-ডেমরা সড়ক ব্যবহার করে সুলতানা কামাল বা কাঁচপুর সেতু ব্যবহার করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ওঠা যাবে। গাবতলী-মাজার রোড-মীরের ধৌড়-আশুলিয়া-ইপিজেড-চন্দ্রা হয়ে উত্তরবঙ্গের গাড়িগুলো চলাচল করতে পারবে। আবার রায়েরবাজার-শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু-জিঞ্জিরা-কেরানীগঞ্জ হয়ে মাওয়া যাওয়া যাবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর নতুন সাতটি প্রবেশপথ নির্মাণে ৬০৮ কোটি টাকার সাতটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে আশুলিয়া-বিরুলিয়া মহাসড়ক ও রামপুরা-আমুলিয়া শেখের জায়গা সড়ক প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু মাঝিনা-কায়েতপাড়া-ত্রিমোহিনী সংযোগ সড়ক, শিরনিরটেক-গাবতলী সেতু পর্যন্ত সংযোগ সড়ক, শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর অবশিষ্ট সংযোগ সড়ক, গাবতলী-সোয়ারীঘাট চার লেন সড়ক ও যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর আট লেন প্রকল্পের কাজ এখনো চলছে। ঢাকা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আতাউর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, শিরনিরটেক-গাবতলী সেতু সংযোগ সড়ক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর সংযোগ সড়কের কাজ চলছে। আর গাবতলী-সোয়ারীঘাট সড়ক চার লেন করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সেটি চলাচলের উপযোগী রাখা হচ্ছে।
আজ প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বাইরে রংপুর চার লেন সড়কটির উদ্বোধন করবেন। ১২৬ দশমিক ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি রংপুর বিভাগের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার প্রবেশমুখ। এ ছাড়া বান্দরবানে ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আলীকদম-থানছি সড়ক উদ্বোধন করবেন তিনি। ১২০ কোটি টাকায় এটি নির্মাণ করা হয়েছে।
ঈদ যাত্রা শুরু : রাজধানীর বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনগুলো ঈদযাত্রীদের কোলাহলে মুখর হতে শুরু করেছে। গতকাল গাবতলী বাস টার্মিনাল, কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে বাড়িমুখো মানুষের ভিড় ছিল। অন্যান্য বাস টার্মিনালে ভিড় অপেক্ষাকৃত কম দেখা গেছে। আজ থেকে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বাড়িমুখো হবে। গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শেষ হয়েছে।
টিকিট হাতে নিয়ে ভিড় ঠেলে সকাল থেকে বাড়ির পথে রওনা দিতে টার্মিনাল ও স্টেশনে উপস্থিত যাত্রীদের চোখেমুখে ছিল খুশির ঝিলিক। গতকাল কমলাপুর থেকে ২৮টি আন্তনগর ট্রেনে ঈদ যাত্রা শুরু হয়। রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য কমলাপুর রেলস্টেশনে অপেক্ষায় থাকা আফজাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ৯টায় ট্রেন যাবে। এক ঘণ্টা আগেই এসেছি। রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, সকাল ৬টা থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন গন্তব্যের ২৮টি আন্তনগর ট্রেন যথা সময়ে কমলাপুর ছেড়ে যায়। রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক সকালে রেলস্টেশনে গিয়ে যাত্রীদের ঈদের আগাম শুভেচ্ছা জানান।
গাবতলী বাস টার্মিনালে সকাল থেকেই ভিড় ছিল। সাকুরা পরিবহনে বরিশাল যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত নাজিম উদ্দিন জানান, ভিড় এড়াতে আগেই বাড়ি যাচ্ছেন। সকাল সাড়ে ৮টায় তাঁর বাস ছাড়ার কথা ছিল, কিন্তু পৌনে ৯টায়ও ছাড়েনি।
একই টার্মিনালে গোল্ডেন লাইন পরিবহনে ফরিদপুর যাওয়ার জন্য পরিবার নিয়ে হাজির হওয়া বেনজীর আহমদ জানান, ১৬ জুলাইয়ের টিকিট পাননি। তাই বাড়তি ছুটি নিয়ে তিনি যাচ্ছেন। ঈগল পরিবহনে খুলনা যাওয়ার জন্য টার্মিনালে এসে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে পারছিলেন না হাকিম মিয়া। জানালেন, আগে বাড়ি যেতে গিয়েও বিপদে পড়তে হচ্ছে। বাস কখন ছাড়বে কেউ বলতে পারছে না।
সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকেও সকাল থেকে বিভিন্ন রুটে যাত্রীদের নিয়ে বাস ছেড়ে যায়। তবে তাঁদের টার্মিনালে পৌঁছতে বেগ পেতে হয়নি।