লেখক: বিশ্বজিত রায় বিশ্ব, সাংবাদিক
বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে জাতিসংঘ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে যুক্ত হতে হলে যে বাধাগুলো টপকাতে হবে বাংলাদেশকে সে পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার। জাতিসংঘের নির্ধারিত তিনটি সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেই বাংলাদেশ প্রবেশ করবে মধ্যম আয়ের দেশে। সূচকের প্রথমটি জাতীয় মাথাপিছু আয়, দ্বিতীয়টি মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং তৃতীয়টি অর্থনৈতিক সংকট। জাতিসংঘের বেঁধে দেয়া প্রতিটি সূচকের রয়েছে আলাদা মানদণ্ড। সেগুলো হলো—জাতীয় মাথাপিছু আয় সর্বনিম্ন এক হাজার ১৯০ ডলারে উন্নীত হতে হবে, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ন্যূনতম ৬৬ বা তার বেশি অর্জন এবং অর্থনৈতিক সংকট সূচকে ৩২ বা তার চেয়েও কম অবস্থানে থাকতে হবে। জাতিসংঘের এক হাজার ১৯০ ডলারের বিপরীতে বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৩১৪ ডলার (যদিও জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯২৬ ডলার)। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে তিনটি সূচকের ওই একটিতেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাকি দুটি সূচক টপকানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছি আমরা। মানবসম্পদ সূচকের সর্বশেষ হিসাব মতে ৬৬ এর বিপরীতে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৩.৮ এবং অর্থনৈতিক সংকট সূচকে ৩২ এর পাশাপাশি বর্তমান অবস্থান ২৫.১-এ। স্বাধীনতার পর গত ৪৪ বছর বাংলাদেশ ছিল নিম্ন আয়ের দেশের তালিকায়। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায় থাকলেও নিম্ন আয়ের খোলস থেকে বের করতে পারেনি বাংলাদেশকে।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এলেও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন ও দারিদ্র্য বিমোচনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে ঘটে আমূল পরিবর্তন। পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলে বড় ধরনের ধাক্কা খায় দক্ষিণ এশিয়ার এ ছোট্ট ভূখণ্ডটি। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর শুরু হয় আঁঁধার কেটে আলোর পথে যাত্রা। এক এক করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণ করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ এখন অনুকরণীয় একটি নাম। মানুষের গড় আয়ু, পানির ব্যবহার, বিদ্যুতের ব্যবহার, টয়লেট সুবিধা, নির্ভরশীলতার অনুপাত, শিক্ষার হার, শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার এবং স্থূল প্রতিবন্ধকতা এই দশটি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অর্জন করে অভাবনীয় সাফল্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স অব বাংলাদেশ এসভিআরএস-২০১৩ জরিপে উঠে আসে এসব অগ্রগতি। বাংলাদেশ বিশ্বের ৭৬তম ধনী রাষ্ট্র এবং ১১তম সুখী দেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ শক্তিশালী ১০টি মুসলিম দেশের একটি। ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে শেখ হাসিনার কল্যাণেই। বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতুটিও তাঁর আমলেই নির্মিত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি সৈন্য প্রেরণ করার কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের। রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে আমাদের অবস্থান ২৭তম। এছাড়াও সমুদ্র সীমানা সংক্রান্ত মামলায় মিয়ানমার ও ভারতের কাছে জয়ী হওয়ায় বিশাল সমুদ্র অঞ্চল প্রাপ্তি, বিদ্যুত্ উত্পন্ন, খিলগাঁও ফ্লাইওভার ও কুড়িল উড়াল সড়ক তৈরি, সেনাবাহিনীর জন্য মেকানাইজ্ড ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়ন গঠন করা, রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি সবই যেন বাস্তব প্রতিফলন। বিশ্বব্যাংকের মতো শক্তিশালী সংস্থাটির অর্থায়ন দূরে সরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের বৃহত্ প্রকল্প হাতে নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্ববাসীকে নিজেদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের পরিচয় দেয় বর্তমান সরকার। যার ধারাবাহিকতায় এলো নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সুখবর। এছাড়াও জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূল করে বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে বর্তমান সরকার।
নিম্ন আয় থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে এ দেশের অর্থনীতি। যার ফলে সারা পৃথিবী এখন বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। কর্মসংস্থান বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক ঋণ গ্রহণে বাংলাদেশকে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকির দেশ বিবেচনা করা হবে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামো সঙ্কটসহ অসংখ্য বাধাও দমাতে পারেনি বাংলাদেশের অর্জনকে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে এখন প্রাপ্তির ঝুড়িতে তৃপ্ত বাংলাদেশ। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশ—বিশ্বব্যাংকের এমন খবরে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির অঙ্গনে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার স্বপ্নপূরণে আরও একধাপ অগ্রগতি। বিশ্বব্যাংকের তালিকায় নিম্ন-মধ্যম আয়ের স্তরে উঠে আসা বড় অর্জন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সফলতা দেখাচ্ছে তখন বিরোধী শক্তিগুলো সরকারের সকল অর্জনকে খাটো করতে দেশবাসীর সামনে বিভ্রান্তিমূলক মিথ্যা বানোয়াট প্রচারণা চালিয়ে আসছে। রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এসব দল-নেতা ও একশ্রেণির ‘সুশীলে’র কথাবার্তায় মনে হয়, হাসিনা সরকারের প্রতিটি অর্জন কাঁটা হয়ে বিঁধছে তাদের গলায়।
মধ্যম আয়ের দেশে যুক্ত হতে হলে বাংলাদেশকে উন্নয়ন অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এ জন্যে সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনাসহ শিক্ষা, অবকাঠামো, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে আনতে হবে ব্যাপক সংস্কার। অগ্রসরতার এই ধারাটি ধরে রাখতে পারলে ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাবে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। দেশবাসীর প্রত্যাশাও তা-ই।