বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে বাগেরহাট

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু, খুলনা-মংলা রেল যোগাযোগ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়া, বিমানবন্দর ও বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসছে বাগেরহাট অঞ্চল

সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ির সর্ববৃহত্ উত্পাদন ক্ষেত্র বাগেরহাট। মংলা বন্দরও এখানে। কিন্তু তারপরও জেলাটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, অনগ্রসর। কিন্তু এই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। সমৃদ্ধি খুব দূরের পথ নয়, এমনটাই এখন সবাই ভাবছেন। এই ভাবনার যথেষ্ট কারণও আছে।

অতি সম্প্রতি জেলার অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। ভারতের সঙ্গে মংলা বন্দর ব্যবহারের চুক্তি হয়েছে। ভারত ও নেপাল মংলা বন্দর ব্যবহার শুরু করলে দ্রুত এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন জাগরণ ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু, খুলনা-মংলা রেল যোগাযোগ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়া, বিমানবন্দর ও বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসছে বাগেরহাট অঞ্চল।

সংশ্লিষ্টদের মতে, উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নাব্যতা সংকটে মংলা সমুদ্র বন্দর ও মংলা ইপিজেড দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। কিন্তু রেল, বিমান ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আসায় সব ক্ষেত্রেই নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। জেলাবাসীর প্রত্যাশা বিমানবন্দর, রেল লাইন, বিদ্যুত্ কেন্দ্র ও পদ্মাসেতু এই এলাকার অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেবে। হযরত খান জাহানের স্মৃতি বিজড়িত বাগেরহাট জেলার দু’টি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্সকে ঘিরে দ্রুত বিকশিত হবে পর্যটন শিল্প। এতোদিন চিংড়ি চাষে গুটিকয়েক মানুষের উন্নতি হয়েছে। এখন উন্নয়ন হবে সার্বিক। চারজন আইন প্রণেতাও উচ্ছ্বসিত জেলার উন্নয়ন নিয়ে। তারা ইত্তেফাককে বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টির কারণেই উন্নয়ন ঘটছে জেলায়। রাস্তা-ঘাটের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বেড়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে সাইনবোর্ড-মোরেলগঞ্জ-বগি-সুন্দরবন আঞ্চলিক মহাসড়ক।

বাগেরহাটের উন্নয়ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় জানা যায়, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে নাগরিক সেবা এখন পৌঁছে যাচ্ছে জনগণের দোরগোড়ায়। বাড়ছে আত্ম-কর্মসংস্থান, সচেতনতা, জনগণের ক্ষমতায়ন। বাগেরহাটের ৫০১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগে ডিজিটাল ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দেয়া হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষা, কৃষি, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, ভেজাল এবং বিষমুক্ত খাবারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাগেরহাটের সাফল্য অনেক বেড়েছে। যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে এসব ক্ষেত্রে অনুকরণীয় হতে পারে বাগেরহাট।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অনেক ভালো হয়েছে। এ বিষয়ে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো: নিজামুল হক মোল্যা জানান, বর্তমান জেলার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। তিনি বলেন, মানুষের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরাধ প্রবণতা কমে গেছে। তাছাড়া পুলিশের জনবল ও তত্পরতাও বেড়েছে।

চাহিদার তুলনায় বেশি উত্পাদিত হচ্ছে চাল

প্রায় ১৭ লাখ মানুষের বাস দক্ষিণের এই জেলায়। গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) খাদ্য উত্পাদন হয়েছে (চাল) ৩ লাখ ৮৪ হাজার ২৮৩ মেট্রিক টন। যা এ জেলার চাহিদার তুলনায় বেশি। বর্তমানে এক লাখ ৪০ হাজার ৫৯৬ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। এর মধ্যে এক ফসলি জমি হচ্ছে ৬৬ হাজার ৯৬৮ হেক্টর আর দো-ফসলি জমি ৫৪ হাজার ৮০ হেক্টর এবং তিন-ফসলি জমি ১৯ হাজার ৬৩ হেক্টর। এ জেলা কৃষিতে বরাবরই ভাল ছিল। বিগত ৫/৬ বছর ধরে সবজি চাষে বিপ্লব ঘটেছে। চিংড়ি ঘেরের আইলে শীতকালিন ও বর্ষাকালিন সবজি উত্পাদন হয়। জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়। জেলার চিতলমারী, মোল্লাহাট, ফকিরহাট, বাগেরহাট সদর, কচুয়া ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় বিপুল পরিমাণ সবজি উত্পন্ন হয়। এতে উপজেলার চাষীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। জলাবদ্ধতার কারণে জেলার চিতলমারী ও মোল্লাহাট উপজেলায় কোন ধান বা সবজি উত্পাদন হতো না। জলাভূমিতে হতো ঢ্যাপের খই। এখানকার মানুষ অনাহারে বা ঢ্যাপের খই খেয়ে জীবনযাপন করতো। সেই চিত্রও পাল্টে গেছে। প্রথমে সেখানে ঘের করে গলদা চিংড়ির চাষ শুরু হয়। পরে ঘেরের আইলে শুরু হয় সবজি চাষ। এতেই বদলে যায় এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা। বাগেরহাট বাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সরদার ফখরুল আলম বলেন, এ জেলায় কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কৃষিপণ্য উত্পাদন হচ্ছে। বাজারে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে।

চিংড়ি থেকে আয় দুই হাজার কোটি টাকা

বাগেরহাটে প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ উত্পাদিত হয়। ‘সাদাসোনা’ খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ি উত্পাদন হয় সর্বত্র। মত্স্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার নয়টি উপজেলায় ৩৫ হাজার ৫৮৪টি বাগদা চিংড়ি খামার ও ৪০ হাজার ৯৪৮টি গলদা চিংড়ি খামার থেকে মোট ২৮ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন চিংড়ি (বাগদা ও গলদা) উত্পাদন হয়। আশির দশক থেকে এ জেলায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে সাদা মাছের উত্পাদন ছিল ৪০ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। আবদুল হালিম নামের একজন কৃষক জানিয়েছেন, মাছ এবং চিংড়ির জন্য বাগেরহাট এমনিতেই বিখ্যাত। বর্তমানে মাছ চাষের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সবজি চাষ হচ্ছে। যা ঘের প্রধান দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে।

৫ হাজার টন তেল উত্পাদিত হচ্ছে ৬০ মিলে

বাগেরহাট শহর সংলগ্ন দড়াটানা নদীর পাশে ১৯ দশমিক ৩০ একর জমির উপর ১৯৯৫ সালে বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এখানে ৪৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারকেল তেলের মিল রয়েছে ২২টি। আর সব মিলিয়ে জেলায় রয়েছে ৬০টি নারিকেল তেলের মিল। মোট নারকেল তেলের উত্পাদন প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন। উত্পাদিত তেল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাত করা হয়। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর নারকেল উত্পাদন কমে যায়। ফলে তেলের উত্পাদনও কমে যায়। বর্তমানে নারিকেল তেলের উত্পাদন আবার বেড়েছে।

বাগেরহাট সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড এর চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন টগর বলেন, বিগত সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের এই জেলায় মৌলিক কোন উন্নয়ন হয়নি। বর্তমানে এই জেলায় উন্নয়নের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তবে কিছু ভুল পদক্ষেপের বিষয়ে জনমনে ক্ষোভ রয়েছে।

বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সভাপতি মো: শাহ আলম টুকু বলেন, এ জেলা দীর্ঘদিন উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল। বিগত তিন বছরে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে ও অনেক উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। বাগেরহাটের বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, এখন কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই। আমরা শান্তিতে বসবাস করছি।

বাগেরহাট সদর উপজেলা আইপিএম ক্লাব সমিতির সভাপতি শাহ নাজরি ইমাম হাসান (নজর) বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে এ জেলার অনেক কিছু বদলে যাবে। বিশেষ করে ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প ও শিক্ষা খাতের প্রসার ঘটবে। বর্তমান সরকারের আমলে এ জেলায় কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুধু সুন্দরবন নয়, পুরো বাগেরহাট জেলাই হতে পারে ইকো-টুরিজমের এক পরিচ্ছন্ন নগরী। ষাট গম্বজ মসজিদ এবং মসজিদ সংলগ্ন দিঘীটিকে ঘিরে একটি প্রকল্পের কাজ চলছে।

উল্লেখ্য, এক সময় বাগেরহাটের নাম ছিল খলিফাতাবাদ বা প্রতিনিধির শহর। খান আল আযম উলুঘ খান-ই-জাহান গৌড়ের সুলতানদের প্রতিনিধি হিসেবে এ অঞ্চল শাসন করতেন। কেউ কেউ মনে করেন, বরিশালের শাসক আগা বাকেরের নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে। কেউবা মনে করেন পাঠান জায়গীরদার বাকির খাঁর নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে। আবার কারও মতে বাঘ শব্দ থেকে বাগেরহাট নামটি এসেছে। জনশ্রুতি রয়েছে, খান জাহান (রহ:) এর একটি বাগ (ফার্সি শব্দ যার অর্থ-বাগান) বা বাগিচা ছিল। এ বাগ শব্দ থেকে বাগেরহাট হয়েছে। আবার কারও কারও মতে নদীর বাঁকে হাট বসত বিধায় বাঁকেরহাট থেকে বাগেরহাট হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত। ১৮৪২ সালে বাগেরহাট খুলনা মহকুমার অন্তর্গত একটি থানা ছিল। ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট যশোর জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমায় রূপান্তরিত হয়। পরে ছিল খুলনা জেলার একটি মহকুমা। আর বাগেরহাট জেলা হিসেবে উন্নীত হয় ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। আর উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলেও আগামীতে হবে ‘মডেল জেলা’।