বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। সে জন্য কৃষির সার্বিক উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ১৯৫৪-৫৫ সালের তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন তখন কিন্তু তিনি কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাছাড়া যতদিন এ দেশে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি তারপরও দল হিসেবে বিরোধী দলে থাকলেও বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন নিয়ে তারা সদাসর্বদা সোচ্চার ছিল। তারপর ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৪ এবং ২০১৪ থেকে চলমান তৃতীয় মেয়াদ অবধি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের বাস্তবসম্মত কৃষিনীতি এবং তদানুযায়ী বাজেটসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ দেশকে কৃষি উন্নয়নের জন্য এক রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। কৃষিতে ভর্তুকি, সফল সার, বীজ ও সেচ ব্যবস্থাপনা, গবেষণায় প্রণোদনা, কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য এলজিইডির মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন, উন্নত বীজের জন্য মৃতপ্রায় বিএডিসিকে শক্তিশালীকরণ প্রভৃতি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছে।
অথচ এ দেশের উন্নয়নের অন্যতম দিকপাল খেটেখাওয়া কৃষকরা তাদের মাঠে আমাদের জন্যই ফসল উৎপাদন করার জন্য সার আনতে গিয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে জীবন দিয়েছেন। জীবন দিতে হয়েছে সেচকার্যের জন্য বিদ্যুৎ চাইতে গিয়ে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর মতোই বুঝতে পেরেছিলেন যে, যে দেশের শতকরা ৮০ ভাগই খেটেখাওয়া কৃষিজীবী মানুষ, সেখানে অন্য যা কিছুই করা হোক না কেন সেই ৮০ ভাগ মানুষের পাশে না দাঁড়ালে এ দেশ দাঁড়াবে না এবং দাঁড়াবে না এ দেশের অর্থনীতিও। তিনি তাঁর সরকারের প্রথম (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদেই কৃষিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন দেশের আরেক বিশিষ্ট রাজনীতিক ও বাংলার অগ্নিকন্যা খ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরীকে। তিনি তাঁর সততা, জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রথম বছরেই কৃষিতে বাম্পার ফলন ঘটাতে সমর্থ হন। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বছরের মাথায় রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন করে সরকারের তৃতীয় বছরেই দেশকে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সমর্থ হন। সেই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ওই সময়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক সেরেস কৃষি পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। আরো পেয়েছিলেন দেশরতœ, কৃষকরতœ ইত্যাদি খেতাব, পদক ও পুরস্কার।
২০০১ সালে সেই সরকারের শেষ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক অর্থাৎ দুই কোটি পঞ্চাশ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করে রেখে যান। যা পরবর্তীতে কমে দুই কোটি টনের নিচে চলে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে রাসায়নিক সার, জ্বালানি, বিভিন্ন ধরনের উন্নতজাতের হাইব্রিড বীজ এবং আমদানিযোগ্য কীটনাশকের দাম বেশি থাকা সত্ত্বেও এগুলোর সঙ্গে সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে চলেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরপর প্রতি বছর বাম্পার ফলনে দেশের এখনো মোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে পূর্বের মেয়াদের দ্বিগুণ হয়ে এখন প্রায় চার কোটি টনের কাছাকাছি। কৃষিতে বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনুক‚ল পরিবেশ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ফলনশীল জাত আবিষ্কার করে কৃষিবিপ্লব ঘটাতে সহায়তা করছেন। এখন পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, তেল ইত্যাদি কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি।
দানাদার খাদ্যোৎপাদনে মূল কৃষির পাশাপাশি এর উপখাত হিসেবে প্রোটিনের উৎস মাছ, ডিম, মাংস ইত্যাদিতেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি করছি। এক সময় আন্তর্জাতিক নিন্দুকরা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে যে অপপ্রচার চালাতেন জননেত্রী শেখ হাসিনার তিন মেয়াদের সরকার সেটা ঘুচিয়ে বিশ্বের দরবারে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকদের বয়সের সময়সীমা উঠিয়ে দিয়েছেন, যাতে একজন দক্ষ গবেষক চাকরিতে না থাকলেও যেন তিনি দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারেন। আর সে জন্যই বাংলাদেশের এক সময়ের সোনালি আঁশ পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর জন্য সদ্যপ্রয়াত জিনবিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম পাটের জীবন রহস্য আবিষ্কার করেছেন। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের কারণে। তিনি কৃষকের ঋণসুবিধা সহজীকরণ করার অংশ হিসেবে মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। সে জন্যই তিনি বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ এবার যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সম্মানসূচক কৃষিপদকে ভূষিত হয়েছেন। আর সম্প্রতি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের একজন প্রতিনিধি এসে সম্মাননা ক্রেস্টটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী পুরস্কারটি গ্রহণের সময় তিনবারের সফল কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীও তাঁর পাশে উপস্থিত ছিলেন এবং স্বভাবজাতভাবেই তিনি প্রতিবারের মতো এবারো পুরস্কারটি দেশের আপামর কৃষক ও এর সঙ্গে যারা জড়িত তাঁদের সবাইকে উৎসর্গ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফল কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন, এটি তারই অংশ। যে কোনো পুরস্কার প্রাপ্তিতে যেমন সম্মানবোধ আসে, ঠিক এর জন্য দায়িত্ববোধও অনেকটা বেড়ে যায়। সৌভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সর্বদাই সজাগ রয়েছেন।
ইদানীং কৃষি বাজেট আলোচনায় রাসায়নিক সার, জ্বালানি, বীজ ইত্যাদিতে ভর্তুকি দিয়ে পরোক্ষভাবে কৃষকদের যে সহায়তাটা দেয়া হয় তা পণ্যে না দিয়ে কৃষককে সরাসরি ক্যাশ হিসেবে দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে কৃষককে সহায়তা হিসেবে সরাসরি ক্যাশ টাকা দিলেও বর্তমানে কৃষি উপকরণে দেয়া ভর্তুকি কোনো অবস্থাতেই রহিত করা বা কমানো যাবে না। তাতে ফসল উৎপাদনের মাঝপথে গিয়ে কৃষক পুঁজি ঘাটতিতে ঋণগ্রস্ত হয়ে মহাজনের খপ্পরে/পাল্লায় পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান কৃষি বাজেট আরো অনেক বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে। তাছাড়া বিদেশি দাতা সংস্থা কৃষিতে ভর্তুকি কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়ে আসছে সর্বক্ষণ। এসব কিছুকে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করেই সরাসরি যাতে ভর্তুকির অর্থ কৃষকের হাতে দেয়া যায় তা নিয়েও সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে। হয়তো বাংলার কৃষককুল এক সময় এটাও তাদের হাতের নাগালের মধ্যেই পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কৃষিবিদ ড. মো. হুমায়ুন কবীর : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।