ঈদের আগেই প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে চার লেনের জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক

ঈদের আগে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জেলার মানুষের জন্য সুখবর নিয়ে এসেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। দ্বিগুণ সময় ও দ্বিগুণ ব্যয় লাগলেও অবশেষে শেষ হতে চলেছে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চার লেন প্রকল্পের কাজ। ৮৭ কিলোমিটারের মধ্যে ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে ৭৪ কিলোমিটারের কাজ। বাকি অংশের কাজও শেষের পথে। এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ছাড়াও নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ যেতে এই মহাসড়কের সম্প্রসারিত অংশের সুফল পাবেন যাত্রী ও গাড়িচালকরা।

এখন এ মহাসড়কে দিনে চলাচল করছে ২৫ হাজার গাড়ি। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ চলাচলের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সময়ও দ্বিগুণ কমেছে। আগে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ যেতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগত। নতুন মহাসড়কে এই অংশ অতিক্রম করতে এখন লাগছে সোয়া ঘণ্টা।

তবে ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ শহরে ঢোকার আগে যানজটে স্বস্তি উবে যেতে পারে যাত্রীদের। গাড়িচালকরা জানান, মহাখালী থেকে গাজীপুর অংশে আড়াআড়ি পারাপারের জন্য ডিভাইডার (রাস্তার বিভাজক) কেটে নেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ শহরে ঢোকার আগে বাসগুলো ফিলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে যায়। এ কারণে এসব অংশে যান চলাচলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ শহরের রাস্তা দুই লেনের। মহাসড়ক থেকে একসঙ্গে অনেক গাড়ি চার লেন থেকে হঠাৎ দুই লেনে পড়ে চলাচলে বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে দিচ্ছে।

আবার ভালুকা ও ত্রিশাল থেকে প্রতিদিন মাছবাহী ৪০০ ট্রাক থেকে পানি পড়ে নষ্ট হচ্ছে নতুন মহাসড়ক। মহাসড়ক রক্ষায় ড্রাম থেকে পানি পড়া বন্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে গত বুধবার ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক। তিনি এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রকল্প পরিচালককে।

সওজ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ৩০ জুনের মধ্যে প্রায় ৮৭ কিলোমিটার জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল। ইতিমধ্যে ৭৪ কিলোমিটারের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। চারটি অংশেই বাকি ১৩ কিলোমিটার রাস্তা দুই লেন থেকে চার লেন করার কাজ চলছে।

অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, দেশের আটটি জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার জন্য প্রথমে বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরে সংস্থাটি তা প্রত্যাহার করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিগত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ২০১০ সালের জুলাইয়ে কাজ শুরু করে ২০১৩ সালের জুনে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯০২ কোটি ২২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। চারটি অংশে ভাগ করে কার্যাদেশ দেওয়ার পর দুটি অংশে কাজ বন্ধ থাকে টানা দেড় বছর। পরে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে বন্ধ থাকা দুটি অংশের কাজে গতি আসে।

পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুই দফা। দুই দফায় ব্যয় বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৮১৫ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার টাকা। প্রকল্প পরিচালক হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত ৮৭ দশমিক ১৮ কিলোমিটারের মধ্যে ৭৪ দশমিক ১২ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা পুরো কাজ দ্রুত শেষ করতে সচেষ্ট আছি।’

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে চার লেন মহাসড়ক, মাওনায় উড়াল সড়ক, সালনা রেল সেতু নির্মাণ শেষ হয়েছে। মাওনা উড়াল সড়ক দিয়েও গাড়ি চলাচল করছে। কোথাও বিটুমিনাস ওয়ারিং কোর্সের কাজ চলছে, কোথাও মিডিয়ান ও সবুজায়নের কাজ চলছে। মহাসড়কের চার লেনের মধ্যে বিভাজক মিডিয়ান নির্মাণ, নিরাপত্তা পিলার স্থাপনের কাজ ঈদের আগেই শেষ হবে। মহাসড়কের ৭৪ কিলোমিটার অংশ এখন ১৮ দশমিক ৬ মিটার প্রশস্ত। প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রশস্ত দুটি মূল লেনের মধ্যস্থলে মিডিয়ান নির্মাণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ধীরগতির গাড়ির জন্য আলাদা দুই মিটার প্রশস্ত সড়ক রাখা হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ আছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত।

সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক উন্নয়ন নামের এ প্রকল্পে সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯০ শতাংশ। প্রথম ও দ্বিতীয় অংশে জয়দেবপুর থেকে মাওনা পর্যন্ত ৩০ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার অংশে ৯৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এ দুটি অংশ বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। তৃতীয় অংশে শ্রীপুরের নয়নপুর থেকে ময়মনসিংহের ত্রিশালের রায়মনি পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটার অংশে যৌথভাবে করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমবিইসি ও পিবিএল। এ অংশে অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। চারটি অংশের মধ্যে পিছিয়ে রয়েছে তৃতীয় অংশের অধীন ভালুকা এলাকা। এ অংশে ১৮ কিলোমিটারে চার লেনের সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। বাকি অংশে রোলার, এক্সকাভেটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে কাজ চলছে। প্রকৌশলীরা বলছেন, বৃষ্টিপাতের জন্য এখানে নির্মাণকাজ ব্যাহত হয়েছে।

চতুর্থ অংশ রায়মনি থেকে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৩২৯ কিলোমিটারে নির্মাণকাজ করছে এমসিসিসি ও তমা নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ অংশে অগ্রগতি ৮৯ শতাংশ। প্রকল্পের ১৫৫টি বক্স কালভার্টের মধ্যে ১৪৮টি ও পাঁচটি সেতুর সব কটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সেতুগুলো নির্মাণ করা হয়েছে ভালুকা, বানার, খীরু, সুতিয়া ও পাগাড়িয়ায়।

প্রকল্প পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নতুন মহাসড়কের স্থায়িত্ব ২০ বছর। সাত বছর পর ওভার লে করতে হবে। মহাসড়কে ১৫ টনের বেশি ভারবাহী পরিবহন চলাচল করতে পারবে না। ওজন নিয়ন্ত্রণ করা না হলে মহাসড়ক মেয়াদের আগেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই দ্রুত ওজন নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র বসানো উচিত। এ মহাসড়কে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন প্রায় সমানতালে চলাচল করে। মহাসড়কের ভালুকা ও ত্রিশালে মাছ বহনকারী ট্রাকের পানি পড়ে বিভিন্ন অংশ নষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছি ১ জুলাই। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত।’

বাড়ির কাছে ভোগান্তির আশঙ্কা : ময়মনসিংহ থেকে নিয়ামুল কবীর সজল জানান, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চার লেন প্রকল্পের ময়মনসিংহ অংশে শুরুর স্থান হলো শহরের চরপাড়া মোড়-মাসকান্দা-দীঘারকান্দা এলাকা। প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এ অংশের রাস্তার নির্মাণকাজ শেষ পুরোপুরি হয়নি। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহরে আসা বাসগুলো এ অংশ দিয়েই মাসকান্দা বাস টার্মিনালে ঢোকে। এ স্থানটুকুর কারণে ঈদে ময়মনসিংহে আসা যাত্রীরা একেবারে বাড়ির কাছে এসে বিড়ম্বনায় পড়তে পারে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মাসকান্দা এলাকায় চার লেনের কাজ এক দিকে শেষ হয়েছে, আরেক দিকে হচ্ছে। এ কারণে সব যানবাহন এ জায়গায় এসে একমুখী হয়ে চলাচল করছে। এতে ওই এলাকায় প্রতিদিন যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

মাসকান্দা এলাকার অসমাপ্ত কাজের কারণে মাসকান্দা বাস টার্মিনালের ঢাকাগামী ও ঢাকা থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢুকতে ও বের হতে বিড়ম্বনায় পড়ছে। শহরের চরপাড়া মোড়ে চার লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। এ মোড়টি আরসিসি দিয়ে ঢালাই করা হয়েছে। তবে ডিভাইডারগুলো এখনো নির্মাণ করা হয়নি। এ জন্য এখানে সাবধানে চলতে গিয়ে ও মোড় ঘোরাতে গিয়ে যানবাহনগুলো বিপাকে পড়ছে।

ময়মনসিংহ জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন বলেন, চার লেন প্রকল্পে শহরের অংশের কাজ দ্রুত শেষ করা উচিত। না হলে মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে। চার লেন প্রকল্পের কর্মচারীরা বলেন, তাঁরা ঈদের আগেই ময়মনসিংহ শহরের অংশের কাজ শেষ করতে দিনরাত কাজ করছেন।