মানুষ মানুষের জন্য

নিজের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে এলাকায় গড়ে তুলেছেন বৃদ্ধাশ্রম, স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, পাকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্টসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। সবকিছুই মানুষের জন্য। মানবসেবার এমনই এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বাকসী গ্রামের সুকুমার মৃধা। প্রচ্ছদ লিখেছেন পংকজ মণ্ডল

মানবসেবার অঙ্গীকার নিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে আলোকশিখা প্রজ্বালন করে চলেছেন তিনি নিরন্তর। ব্যক্তিজীবনের স্বপ্ন-সাধ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। নিজের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে এলাকায় গড়ে তুলেছেন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, ধর্মীয় উপাসনালয়, গ্রন্থাগার, পাকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্টসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। এর ফলে অবহেলিত জনপদের সুবিধাবঞ্চিত অনেকে খুঁজে পেয়েছেন নতুন ঠিকানা। বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়েছে তাদের। মানবসেবার এমনই এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বাকসী গ্রামের সুকুমার মৃধা।
পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। স্বপ্ন ছিল সমাজে অবহেলিত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে গিয়ে সে স্বপ্ন দীর্ঘদিন অন্ধকারেই ডুবে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো বাধা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আপ্রাণ চেষ্টা ও কর্মতৎপরতা চালিয়ে গেছেন দিনের পর দিন। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মানুষের কথা ভেবে ২০০৬ সালে স্বর্গীয় মা-বাবার স্মরণে রাজলক্ষ্মী নামে একটি সেবাধর্মী ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন তিনি। আর এর মাধ্যমেই শুরু হয় তার নতুন এক যাত্রা। সে যাত্রায় কেবলই আলো ছড়িয়েছেন সুকুমার মৃধা।
শুরুর দিকে নিজের ক্রয়কৃত জমিতে রাজলক্ষ্মী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এলাকার গরিব মেধাবী ছাত্রীদের পড়াশোনার সুব্যবস্থা করা হয় এখানে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এরপর আর থেমে থাকেনি কর্মকাণ্ড।

গত ৮-৯ বছরের মধ্যে একের পর এক গড়ে তুলেছেন রাজলক্ষ্মী মহাবিদ্যালয়, রাজলক্ষ্মী মা সারদা শিশু তীর্থ কিন্ডার গার্টেন, রাজলক্ষ্মী সেবা সদন হাসপাতাল, রাজলক্ষ্মী ছাত্রী নিবাস, রাজলক্ষ্মী ছাত্রাবাস, রাজলক্ষ্মী বৃদ্ধা আশ্রম, দারু সুন্নাত দাখিল মাদ্রসা, রাজলক্ষ্মী মন্দির, রাজলক্ষ্মী শেরেবাংলা বিদ্যানিকেতন, রাজলক্ষ্মী গ্রন্থাগারসহ অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ বিঘা জায়গাজুড়ে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। অনেক অভাবী ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের সন্তানরা এখানে এসে অবৈতনিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। পাশাপাশি অসহায় বৃদ্ধাদের পরম মমতায় স্থান দেওয়া হয়েছে রাজলক্ষ্মী বৃদ্ধাশ্রমে। তাদের জন্য থাকা-খাওয়াসহ নিয়মিত বসবাসের সব ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে এখানে।
সময়ে-অসময়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ রাজলক্ষ্মী সেবা সদন হাসপাতাল থেকে রোগ-ব্যাধিতে পাচ্ছেন ফ্রি চিকিৎসা সেবা। জ্ঞান পিপাসু পাঠকরা পাঠাগারে এসে নিজেদের পছন্দমতো বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। শিশুরা কিন্ডার গার্টেন থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে। ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে মসজিদ এবং মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সম্প্রীতির এক সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে। ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ঊধর্ে্ব থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিবেদিতভাবে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
পাশাপাশি সুকুমার মৃধা একজন বৃক্ষপ্রেমীও। নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজ ও তার আশপাশে বিশাল জায়গা নিয়ে তিনি ফলদ ও বনজ গাছের বাগান করেছেন। শত শত আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের গাছ লাগিয়েছেন এখানে। এর মধ্যে ফল ধরতে শুরু করেছে এসব গাছে। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অতিথি ও দর্শনার্থীদের বাগানের বিষমুক্ত ফল দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন তিনি। অবসর সময় পেলে ছুটে যান বাগানে। হারিয়ে যান প্রকৃতির মধ্যে।
১৯৫৬ সালের ২ জানুয়ারি প্রত্যন্ত গ্রাম বাকসীর এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সুকুমার মৃধা জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজেন্দ্রনাথ মৃধা পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতা রাজলক্ষ্মী ছিলেন গৃহিণী। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। গ্রামের পাঠশালা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে পার্শ্ববর্তী সেখমাটিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। সেখান থেকে ভর্তি হন খুলনা কমার্স কলেজে। পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরিবারে অসচ্ছলতা ও নানা টানাপড়েনের কারণে অনেক বার পড়াশোনা বন্ধ হতে বসেছিল। কিন্তু সব বাধাকে পাশ কাটিয়ে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছে যান। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮০ সালে খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকায় কাজ করার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। সেখানে চার বছর কাজ করার পর ১৯৮৪ সালে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে হিসাবরক্ষক পদে দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৮৯ সাল থেকে খুলনার রূপসা কলেজে প্রায় ৭ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পারিবারিক জীবনে দুই সন্তানের জনক তিনি। স্ত্রী তাপসী রানী মৃধা পেশায় ব্যাংকার। এলাকার মানুষের জন্য এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে স্ত্রী তাপসী দেবীর উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সব সময়। অকপটে স্বীকার করলেন মৃধা।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম জানান, এলাকার মানুষের জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করছেন সুকুমার মৃধা। তাকে একজন দিকপাল বলা চলে। তার কর্মকাণ্ডের সুনাম এখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। সুকুমার মৃধা প্রকৃত একজন সাদা মনের মানুষ। এলাকার রাস্তা-ঘাট ও ব্রিজ-কালভার্টসহ নিজের পকেটের অর্থ ব্যয় করে এসব তিনি নির্মাণ করছেন। এ ছাড়া যেসব সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন সেটা এলাকাবাসীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তিনি এলাকার গর্বও বটে। এলাকার বাইরে থেকে মানুষ এখানে এসে সেবা গ্রহণ করছেন। সরকারের পাশাপাশি এলাকাবাসীর উন্নয়নে তার অবদান অসামান্য।’
রাজলক্ষ্মী ছাত্রী নিবাসের স্বপ্না মজুমদার, রিক্তা ঘরামী, সঞ্চিতা সরকার, ফাতেমা আক্তারসহ অনেক ছাত্রীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, এখানে এসে তারা একটা নতুন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। পড়াশোনা করার মতো একটা উত্তম পরিবেশ পেয়েছে তারা। এতে দারুণ খুশি সবাই।
বৃদ্ধা আশ্রমে আশ্রয় নেওয়া শতবর্ষী জলধর, কমলা রানী, কাঞ্চন জানান, শেষ বয়সে এসে এখানে আশ্রয় পেয়েছি। তা না হলে পথে পথে ঘুরে মরতে হতো। আমাদের দেখার মতো কেউ ছিল না। এই আশ্রম এখন তাদের শেষ ঠিকানা। রাজলক্ষ্মী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মিলন কান্তি মণ্ডল জানান, এখানে যত সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে সবই মৃধা স্যারের চেষ্টায় হয়েছে। আশপাশে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ছিল না। এর অধিকাংশই তিনি নিজের টাকায় করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা শেখ আতিয়ার রহমান, লুৎফার রহমান, নির্মল মৃধাসহ গ্রামবাসীর অনেকেই জানান, মৃধা বাবু যে কাজগুলো করেছেন তার প্রশংসা মুখে বলে শেষ করা যাবে না। তিনি এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বাইরেও এলাকার গরিব-দুস্থদের মধ্যে নগদ অর্থ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বস্ত্র বিতরণ করে থাকেন। তার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।