মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মহাপরিকল্পনা

মৎস্য উৎপাদন বাড়াতে মহাকর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চাঁদপুরে ইলিশ উন্নয়ন ট্রাস্ট ফান্ড গঠনসহ ইলিশের অভয়াশ্রম গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতের মতো চিংড়ি চাষে দেওয়া হবে প্রণোদনা। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার সরকারি সেচ খালগুলো মাছ চাষের জন্য সমাজভিত্তিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ ছাড়া মাছচাষিরা যেন ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য রুইজাতীয় মাছ আমদানি নিষিদ্ধ করারও চিন্তা রয়েছে সরকারের।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্ধিত সমুদ্রসীমা থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণ বাড়াতে নতুন করে পদ সৃজনসহ জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মাছের পাশাপাশি জলজ সম্পদ যেমনÑ কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, ব্যাঙ ও কুচিয়া চাষ বাড়ানোর ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। মৎস্যসম্পদ বাড়াতে এক অঙ্কের সুদহারে ঋণ দেওয়া ও বেসরকারি খাতের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তরকে আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মৎস্য ও মৎস্যজাত রপ্তানি পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা ও আইন বাস্তবায়নের জন্য সরকারি জনবল বৃদ্ধি করা হবে। একই সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ রপ্তানিতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ, জনবল সৃষ্টি ও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সহনীয় আহরণ ও সংরক্ষণ করার নির্দেন দেন তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মৎস্য খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্যতম চিংড়ি খাত। চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি আফতাবুজ্জামান জানান, বৈঠকে চিংড়ি পোল্ডারের দ্রুত অপসারণ এবং উপযোগী কাঠামো পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাছাড়া সনাতন পদ্ধতির চিংড়ি চাষ, উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষতা ও সামর্থ্যরে অভাবে দেশে পর্যাপ্ত চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তাই মৎস্যচাষিদের ঋণের সুদহার কমানোর বিষয়টি বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পোশাক খাতের মতো মৎস্য খাতেও সব ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি প্রাকৃতিক উৎস থেকে হ্যাচারিতে পর্যাপ্তসংখ্যক ও গুণগত মানসম্পন্ন চিংড়ি পোনা উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বলেন। তাছাড়া প্রাকৃতিক উৎস থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চিংড়ির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রান্তিক চিংড়িচাষিকে এক অঙ্কবিশিষ্ট সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তাছাড়া পোল্ডারের স্লুইস গেটগুলোয় চিংড়ি ঘেরে পরিকল্পিত পানি প্রবেশ ও নির্গমন উপযোগী করে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত জেলেদের মাসিক ১০ কেজি হারে ডিজিএফ খাদ্যশস্য দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানে জনপ্রতি ৪০ কেজিতে উন্নীত করা হয়েছে। এ কারণে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৩ লাখ ৮৫ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ উইং খোলার কথা জানানো হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাঁদপুরে মৎস্য ইনস্টিটিউট ও নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের উন্নয়নের মাধ্যমে ইলিশ গবেষণা উইং স্থাপন করা হবে।
তাছাড়া ইলিশের ব্যাপারে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের অনুরূপ দরিদ্র জেলেদের জন্য ‘ইলিশ উন্নয়ন ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাছাড়া ইলিশের প্রজনন মৌসুমে এক মাস দরিদ্র জেলেদের ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি এম আমজাদ হোসেন বলেন, দেশে রুইজাতীয় মাছ প্রধানত মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হয়। এটি আমাদের মৎস্য খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এসব মাছ আমদানি বন্ধে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণে সভায় অনুরোধ করেছি। এ প্রসঙ্গে সভায় রুইজাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণের জন্য হালদা নদীকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে কাজ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তাছাড়া বাইরে থেকে যেন রুই মাছ প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে বলেন তিনি।
সভায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের ওপর গুরত্বারোপ করেন। তিনি সমুদ্রসম্পদের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। এ জন্য বিশেষায়িত ট্রলারের অনুমতি প্রদান, প্রশিক্ষিত জনবল এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলেন তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২ হাজার ৪৫৭ পদে লোক নেওয়ার কথা বলা হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় ৯২৬টি পদে সম্মতি দেয়। ফলে ১ হাজার ৫৩১টি পদ না থাকায় হালদা নদীর মাছ রক্ষা করা, ইলিশ মাছ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এই পদ সৃষ্টি পুনর্বিবেচনার জন্য সভায় বলা হয়। তাছাড়া মেরিন ফিশারিজ সার্ভেল্যান্স চেকপোস্টে অনুমোদন আছে ২৭টি। এ জন্য জনবল দরকার ৪২৪। কিন্তু আছে ২০৮টি।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, চাষি পর্যায়ে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা সুফল বয়ে আনে না। তাই চাষি পর্যায়ে সেবা পৌঁছানোর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের ইউনিয়ন পর্যায়ে জনবল তৈরি করতে হবে।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, আহরণ ও উন্নয়ন, ইলিশ মাছ সুরক্ষা, হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদ রক্ষা এবং রূপকল্প ২০২১-এ মৎস্য খাতে স্থিরকৃত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১ হাজার ৫৩১টি পদের প্রস্তাব আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণের জন্য ৬০০টি সহকারী পদ সৃষ্টিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।