এমএ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৪৪তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ১৪ ধাপ এগিয়েছে। ২০১৩ সালের চলতি বাজার মূল্যে গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্টের (জিডিপি) বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫৮তম। বর্তমানে জিডিপির বিবেচনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। অন্যদিকে পারচেজিং পাওয়ার প্যারেটি (পিপিপি) বা ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ৩৩তম। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ৩৬তম অবস্থানে ছিল। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই জিডিপির বিবেচনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে তার শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু পারচেজিং পাওয়ার প্যারেটির ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে তার শীর্ষ অবস্থান এরই মধ্যে হারিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির বিচারেও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যাবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। চীন শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে অগ্রগতি সাধন করার কারণেই মূলত তারা বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষস্থানে চলে যাওয়ার মতো অবস্থানে উন্নীত হচ্ছে। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলের ক্ষেত্রে শিল্পায়ন যেমন প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনি তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভ্যারিয়েশনও বিবেচনাযোগ্য। চীন অত্যন্ত সস্তায় যে কোনো ভোক্তার উপযোগী পণ্য ও সেবা সরবরাহ করতে সক্ষম। তারা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ওপর বেশি জোর দিয়েছে। চীনের এই শিল্প কৌশল আমাদের দেশের উন্নয়নে কাজে লাগতে পারে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা চিত্রকল্প জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু কীভাবে এই উন্নয়ন সাধিত হবে সে ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি। আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত জিডিপি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৩ শতাংশ কম। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরার কোনো কারণ অনুধাবন করা গেল না। কারণ সরকারিভাবে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে নানা সমস্যা সত্ত্বেও ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। যদিও সরকারি এই পরিসংখ্যানের প্রতি অনেকেরই আস্থা নেই। এর আগে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রক্ষেপণে বলেছিল, চলতি অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। পঞ্জিকা বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে উৎপাদন সেক্টরে যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাজনিত এই ক্ষতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কম হতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারত। কিন্তু সে অবস্থায় ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার বিষয়টি বিস্ময়করই বটে। কারণ উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের অধিকাংশ নিয়ামকই ছিল অনুপস্থিত। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল অনেকটাই স্থবির।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার-আকৃতি ও সামর্থ্য তাতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে মোট জিডিপির অন্তত চার থেকে পাঁচ শতাংশ নতুন বিনিয়োগ দরকার। এই বিনিয়োগের বেশিরভাগ আবার আসতে হবে ব্যক্তিখাত থেকে। কারণ সরকারি খাতে যে বিনিয়োগ হয় তার বেশিরভাগই সরাসরি উৎপাদন বা প্রোডাকশনে কাজে লাগে না। কিন্তু ব্যক্তিখাতে যে বিনিয়োগ হয়, মূলত সেটাই উৎপাদন যন্ত্রকে গতিশীল করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত হতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রতিবছর ৯ থেকে ১০ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। দেশের মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশই আসে ব্যক্তিখাত থেকে। সরকারি খাতে বিনিয়োগের হার মাত্র ২০ শতাংশের মতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই চিত্র কিছুটা হলেও বদলে গেছে। বর্তমানে যে হারে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে সে তুলনায় ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ তেমন একটা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমরা যদি বিনিয়োগ পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে ব্যক্তিখাতের দীনতাই দৃষ্টিগোচর হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২৮.২৬ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ হয়েছিল ২২.৫৫ শতাংশ। অবশিষ্ট ৫.৭৬ শতাংশ ছিল সরকারি খাতের বিনিয়োগ। পরবর্তী বছর মোট বিনিয়োগের পরিমাণ সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ২৮.৩৯ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ সামান্য হ্রাস পেয়ে ২১.৭৫ শতাংশে নেমে আসে। এ বছর সরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬.৬৪ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের হার ছিল ২৮.৫৮ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যক্তি ও সরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২২.০৩ শতাংশ ও ৬.৫৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৮.৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যক্তিখাতে ২২.০৭ শতাংশ এবং সরকারি খাতে বিনিয়োগ হয় ৬.৯০ শতাংশ। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে এই যে স্থবিরতা, সেটাই প্রবৃদ্ধির হারকে নিচে নামিয়ে রাখছে। এদিকে সরকারি খাতে যে বিনিয়োগ হচ্ছে তার গুণগত মান নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মাঝে সংশয় রয়েছে।
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছি। মোট জিডিপির প্রায় ২৯ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে বলে যে পরিসংখ্যান দেয়া হচ্ছে তাও বাস্তবসম্মত কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। এটা কি নিবন্ধিত বিনিয়োগ নাকি বাস্তব বিনিয়োগ? আমাদের দেশে প্রায়ই বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত প্রকল্পকেই বিনিয়োগ হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হলেই একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হওয়ার পর অনেক প্রকল্পই আর আলোর মুখ দেখে না। বিনিয়োগ প্রকল্প কেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না সে ব্যাপারে নানা ধরনের মতামত থাকতে পারে। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেছেন, বিনিয়োগ কম হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ। চড়া সুদের কারণে অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারছেন না। তার এ বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য উদ্যোক্তারা অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছেন। তাদের এই দাবি কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সুষম প্রতিযোগিতা করার জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। কারণ অধিকাংশ উন্নত দেশেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৩-৪ শতাংশ। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে সুদের হার বেশি বলে স্থানীয় উৎপাদক শ্রেণী আন্তর্জাতিক বাজারে উন্নত দেশের বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমে পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, ব্যাংকগুলো কেন উচ্চ হারে সুদ চার্জ করছে? ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণ আদায়ের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এর সঙ্গে অদৃশ্য বা রাইট-অফ করা ঋণ যোগ করলে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা সামান্য কিছু মানুষের কাছে আটকে আছে। এই বিপুল অংকের ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংক ঋণের টাকা আদায় করতে না পারলেও ব্যাংককে কিন্তু দাতা সংস্থা বা সাধারণ মানুষকে আমানতের ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করতে হচ্ছে। যেসব কারণে ব্যাংকগুলো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুদের হার কমাতে পারছে না তার মধ্যে খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারাটা অন্যতম।
বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় না হওয়ার আর একটি কারণ হচ্ছে সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি। এমন একটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না, যেখানে ঘুষ-দুর্নীতি ছাড়া কাজ আদায় হয়। দুর্নীতির কারণে প্রকল্প ব্যয় ও বাস্তবায়নের সময় উভয়ই বেড়ে যায়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় মার খায়। বাংলাদেশে অবকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি সমস্যা রয়েছে। ভূমি স্বল্পতা ইদানীং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শিল্প স্থাপনের জন্য উপযোগী জমি পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় না থাকলে কোনো উদ্যোক্তা, তিনি স্থানীয় হোন আর বিদেশী, বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। কারণ একজন মানুষ নিশ্চয়ই বিনিয়োগ করতে এসে তার জীবন হারাতে চাইবেন না। অনেকেই বলতে চাইছেন, উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেয়া যেতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলে। আর সুশাসন হচ্ছে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। দুর্নীতির বিপরীতে যেমন উন্নয়ন আশা করা যায় না, তেমনি গণতন্ত্র বা সুশাসনকে বিসর্জন দিয়েও উন্নয়ন কাম্য হতে পারে না। ব্যক্তিখাতের যারা ভালো উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত, তাদের অনেকেই নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে।
দেশে তারুণ্যের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। এ সম্পদ কাজে লাগানোর প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থায় রয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্থ হচ্ছে, যখন একটি দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বা তার কাছাকাছির বয়স থাকে ১৫ বছর থেকে ৫৯ বছর। বাংলাদেশ বর্তমানে এ অবস্থার মাঝে বিরাজ করছে। এই অবস্থা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বজায় থাকবে। একটি দেশের জীবনে এ ধরনের সুযোগ একবারই আসে। যারা এই সুযোগ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে তারাই উন্নতি করতে পেরেছে। বাংলাদেশ যদি সত্যি সত্যি স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে চায় তাহলে জনসংখ্যার এ অবস্থাকে সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজে লাগাতে হবে। উন্নয়নের পথে মানবসৃষ্ট বাধা দূর করতে পারলে আগামীতে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এজন্য আমাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে জাতীয় উন্নয়নে নিবেদিত হতে হবে।